বীরাঙ্গনাদের নিয়ে ভাবনা কতটা বদলেছে
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ৪ নম্বর গ্যালারিতে বীরাঙ্গনাদের স্মৃতিচিহ্নের পাশাপাশি এক পিতার লেখা চিঠি সংরক্ষিত রয়েছে। চিঠিতে নির্যাতনের শিকার নারীর নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে লেখা:
‘মাননীয় বঙ্গবন্ধু, ...স্বাধীনতার প্রাক্কালে বর্বর পাক সৈনিকরা এবং এই দেশের দালাল রাজাকার আমার সকল আশা আকাঙ্ক্ষা শেষ করিয়া দেয়। ...আমার একমাত্র মেয়েকে তারা ধরিয়া লইয়া যায়। ...১৬ তারিখে স্বাধীনতার পর ১৭ তারিখে সে বাসায় ফিরিয়া আসে। কিন্তু মান ইজ্জত সমস্তই বিসর্জন দিয়া। এখন সে বীরাঙ্গনা। আমি এই বীরাঙ্গনা মেয়েকে নিয়া খুব অসুবিধায় আছি।’
চিঠিতে বঙ্গবন্ধুর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে যাতে ওই বীরাঙ্গনার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের নারীর মূল্যায়ন চিত্রের অমূল্য দলিল হয়ে আছে এই চিঠি।
একাত্তরের বীরাঙ্গনা নারীদের নিয়ে গবেষণা করছেন সুরমা জাহিদ। তিনি বলেছেন, এমন কয়েকজন বীরাঙ্গনা নারীর কথা আমি জানি, দেশ স্বাধীন হবার পর কোথাও যাবার জায়গা না পেয়ে পতিতাপল্লীতে আশ্রয় নিতে তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন।
ড. নীলিমা ইব্রাহীম ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থের ভূমিকাতেই পাঠককে অনুরোধ করেছেন: ‘আপনারা অতি উৎসাহী হয়ে বীরাঙ্গনাদের নাম ঠিকানা জানতে চাইবেন না।’ এই বইতে এক বীরাঙ্গনা তাঁর পরিচয়ে বলছেন: ‘আমার পরিচয়? না, দেবার মতো আমার কোনও পরিচয় আজ আর অবশিষ্ট নেই। পাড়ার ছেলে মেয়েরা আদর করে ডাকে ফতি পাগলী। সত্যি কথা বলতে কি আমি কিন্তু পাগল নই। যারা আমাকে পাগল বলে আসলে তারাই পাগল। এ সত্যি কথাটা ওরা জানে না।’
এ বই থেকে জানা যায়, ভূক্তভোগী বীরাঙ্গনারা অনেকেই পাকিস্তানে চলে যেতে চেয়েছিলেন। যাতে সেখানে তাদের কেউ না চেনে, যদি পতিতালয়ে থাকতে হয়-অথবা রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করতে হয় তারপরেও তাঁরা পরিচিত সমাজে ফিরতে চাননি।
বিজয় তখন সন্নিকটে, পাকিস্তানি সেনারা যখন বন্দি হচ্ছিল বিভিন্ন জায়গায় তখন বিভিন্ন বাঙ্কার থেকে বীরাঙ্গনাদের উদ্ধার করা হচ্ছিল; এই সময় বাঙালি ছেলে, কিশোর, নারী-পুরুষ তাদের গালি দিতে ছাড়েনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এক কর্মকর্তা জানান, অনেক মুক্তিযোদ্ধাও বীরাঙ্গনাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, তাদের অবদান ছোট করে দেখেন।
সময় কি বদলেছে? মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ৪ নম্বর গ্যালারীর কথা বলে শুরু করেছিলাম, সেখানে বীরাঙ্গনার পিতার অসহায়ত্বের দলিল হয়ে দেয়ালে সেঁটে থাকা চিঠির পাশে টাঙিয়ে রাখা আছে পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা কিছু স্কেচ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারী গাইড মিতুয়া মমতাজ জানালেন, নারী নির্যাতনের এ সব স্কেচ বা ছবির সামনে এসে অনেকেই আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি করে, বাজে রকমভাবে ছবিতে স্পর্শ করে। মিতুয়া মনে করেন, কিশোরদের অনেকে মু্ক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানে না বলেই এমন করে। অনেক সময় বড়রাও এই ভুল করে। তবে তাদের বোঝানো হলে ভুল স্বীকার করে ‘স্যরি’ বলে।
স্মরণ করা যেতে পারে শিরিন মিতুলের কথা, যিনি মুক্তিযুদ্ধে পুরুষ বেশে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নারী তাঁর নারীত্ব গোপন রেখে, বিসর্জন দিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার জুগিয়ে, নৌকা পারাপারে সম্মুখে থেকে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আড়াল করে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিয়ে, অস্ত্র পৌঁছানোর কাজে সরাসরি অংশ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, এই প্রজন্ম তা জানুক এবং নারীর প্রতি সামাজিক অবিচারের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসুক।
/তারা/