মাসকা: কথিত আদালত
প্রতিবছরই আগস্টের প্রথম রোববার পালিত হয় আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস। আসলে বন্ধুত্বকে কোনও দিবসে বেঁধে রাখা যায় না। ‘বন্ধু’ শব্দটির অর্থ বেশ গভীরে। বন্ধুত্বের নেই দিনক্ষণ, সীমা-পরিসীমা। জীবনের প্রতিটি বাঁকে বয়ে চলা বন্ধুদের প্রতিনিয়তই মনে পড়ে। এ সম্পর্ক যেন নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে।
তখন প্রাইমারিতে পড়ি, দেওড়া পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম বলে স্কুলের নেতৃত্ব এক প্রকার আমার কাঁধেই ছিল। নেতৃত্ব বলতে পিটি করানো, ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্বে থাকা— এসবই। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ফাস্ট বয় থাকায় বলতে গেলে আমার একচ্ছত্র ছুটে চলা। তারওপর বাড়ি লাগোয়া স্কুল হওয়ায় জুনিয়রদের সঙ্গে ‘ক্ষমতা দেখানো’ খুব কঠিন কাজও ছিল না। তাছাড়া সেসময়ের সব সাহসী বন্ধুদের পাশে রাখতাম নিজস্ব সিন্ডিকেট শক্তিশালী রাখতে। তারাই ছিল আমার প্রথম বন্ধু, সবচেয়ে কাছের ও বিশ্বস্ত। এখনও তেমনটাই ভাবি।
এদের মধ্যে ছিল— রফিক, রিপন, রিক্তার, পারভেজ, বাকিউল্লাহ, লিমনসহ আরও অনেকেই। বর্তমানে যে যার কর্ম-সংসার সামলানো নিয়ে ব্যস্ত আছে। আমি ছাড়া অন্যরা পড়াশোনার তরী ধরে না রাখলেও স্ব স্ব জায়গায় তারা বেশ প্রতিষ্ঠিত।
যাইহোক, কথায় ফিরে আসি। স্কুল সীমানায় প্রভাব আর লোকবল নিজস্ব হওয়ায় মাথায় একদিন দুষ্টু বুদ্ধি আঁটলো। বলে রাখি, ছোটবেলা থেকেই আমি বেশ চঞ্চল আর দিলখোলা প্রকৃতির। তবে ঘরে ছিলাম ঠিক উল্টো। রক্ষণাত্মক পরিবারে বেড়ে উঠার কারণে ঘরে বেশ ভয়ে থাকতাম। স্কুল টাইম ছাড়া বাইরে বের হওয়াতেও অঘোষিত ১৪৪ ধারা জারি থাকতো। এজন্যই এই টাইমেই রাজত্বের স্বাদ গ্রহণ করেছি।
দুষ্টু বুদ্ধিটা হলো, স্কুলে একটি বিচারিক আদালত গঠন করবো। তখন বিটিভিতে জসিম, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে এসব ‘নিজস্ব আদালত’ দেখে অভ্যস্ত। সেখান থেকেই বুদ্ধিটা আসে। কথা হলো, আদালত বানাবো কোথায়? তখনকার সময়ে আমাদের স্কুলের উত্তর দিকের বিল্ডিংয়ের পাশের দুই রুম বাদে বাকিটা পরিত্যক্ত ছিল। এসব রুমে স্কুলের যত ভাঙাচোরা বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল আছে— সেগুলো রাখা হতো। আমি ভাবলাম, বদ্ধ রুমেই এই আদালত গঠন করা হউক।
রিপনকে বললাম, আদালতের নাম কী দেওয়া যায়? সে সাথে সাথেই বলে উঠলো ‘মাসকা’। শব্দটা খুব পরিচিত না হলেও এটা যে ডিপজলের ছবি দেখার কুফল, সেটা আবিষ্কার দেখেই অনুধাবন করেছি। নাম সবার মনে ধরলো। তারপর ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চক দিয়ে বড় করে লেখা হলো ‘মাসকা’। যেহেতু সব কাজে আমার নেতৃত্ব চলে, তাই পদাধিকার বলে আমি-ই এই আদালতের বিচারক।
পরিত্যক্ত টেবিলের ওপর বসানো হলো ভাঙা চেয়ার, যেটার হাতল আর পেছনে হেলান দেওয়ার কাঠও ছিল না। চেয়ারে বসার জন্য সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বেঞ্চের খুলে পড়া লম্বা তক্তা।
আমরা আদালত বসাতাম টিফিন পিরিয়ডে। আসামি বানাতাম জুনিয়রদের। এ ছাড়া তো জোর খাটানোর কেউ নেই! আবার এও ভাবতাম, কাকে ধরলে ঝামেলা হবে না। মানে ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’। ‘আসামি’ ধরার কাজ চালাতো রিপন আর রিক্তার। তারা আবার মাসকার অ্যাডভোকেটও। রফিক, পারভেজ— এরা সহকারী। আর প্রহরী হিসেবে নিযুক্ত ছিল লিমন। আদালত চলাকালে সে হাতে একটি কাঠ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতো।
পরিত্যক্ত রুমে যেহেতু এই কারবার, তাই সব দরজা এমনিতেও বন্ধ থাকতো। তাহলে প্রহরী কেন রাখা? কারণ আমাদের প্রিন্সিপাল খুবই রাগী ছিলেন, রইছ আলী স্যার। স্যারকে দেখলে মশা মাছিও নড়ে না— আমরা এমনটাই ভাবতাম। মূলত স্যারের চোখ ফাঁকি দিতেই প্রহরী রাখা। টিফিন পিরিয়ডে স্যার যখন জোহরের নামাজে যেতেন, তখনই মাসকার কার্যক্রম চালাতাম। তবে প্রতিদিন না, সপ্তাহে বার’দুয়েক।
অন্যদিনের মতো একদিন মাসকার বিচারিক কার্যক্রম আরম্ভ করলাম। জুনিয়র ব্যাচের একজনকে (সম্ভবত নাম মনির) আসামি হিসেবে ধরে আনা হলো। মনির যে কিঞ্চিৎ সাহসী ছেলে, সেটা আমাদের জানা ছিল না। আদালত শুরু হলো। আমি হাফপ্যান্ট পরা জর্জ ফুলপ্যান্ট উকিলের বয়ান শুনছি। হুদাই বক্করচক্কর কথা শুনে রায় দিলাম, তাকে ছোট কাঠের টুকরা দিয়ে পাছায় বাড়ি দেওয়া হবে। বলে রাখি, যাকে আমরা টার্গেট করতাম তার কোয়ালিটি অনুযায়ী অপরাধ বানিয়ে নিতাম।
সেদিন ভেতরে ‘মাইর’ চলছে আর প্রহরীর দায়িত্বে থাকা লিমন মনের আনন্দে হাতের কাঠের টুকরাকে গিটার মনে করে বাজিয়ে গান গাইছে। হেড স্যার সেদিন দেরীতে নামাজে যাচ্ছেন, আমাদের জানা ছিল না। মনে করেছিলাম, নামাজে চলে গেছেন। স্যার হঠাৎ মাঠে এসে ডাক দিয়ে বললেন, ‘এখানে কী হচ্ছে?’ লিমন কোনও উত্তর না দিয়েই ভেতরে ভোঁ দৌড়। স্যারের সন্দেহ আরও প্রবল হলো। আমাকে যখন লিমন বললো ‘স্যার ডাকছেন’, কলিজার পানি তখনই শুকিয়ে গেছে। প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলার মত অবস্থা! রিপন তো ভয়ের উত্তেজনায় মনের ভুলে হাতে থাকা কাঠ দিয়ে বাঁশে মারলো আরও জোরে বাড়ি। স্যার তো রেগে আগুন, আজ রক্ষা নেই।
সবাইকে ডাকা হলো। আমি বাদে বাকিরা সব মাথা নিচু করে স্যারের রুদ্রমূর্তির সামনে দাঁড়ালো। আর আমি চুপিসারে ইতিকা ম্যামের পেছনে এমনভাবে দাঁড়ালাম, যেন কিছুই জানি না। এখানে ছিলাম-ই না। ম্যাম আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। তিনিও সাপোর্ট দিলেন, আমি এসবে থাকতে পারি না। আমরা একসময় নারী শিক্ষককে ‘আফা’ বলে সম্বোধন করতাম। উনিই ‘ম্যাম’ বলা সবাইকে আয়ত্ত করিয়েছিলেন।
হেড স্যার প্রত্যেক ‘অপরাধীকে’ শার্টের কলারে এক হাতে ধরে ধুমাইয়া পেটাচ্ছেন। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, কেউ আমার নাম বলছে না। অথচ এটার মূল পরিকল্পনাকারী আমি। তখন না বুঝলেও এখন টের পাই, এটাই বন্ধুত্ব। কতটা ভালোবাসতো আমায় তারা। এই ছোট্ট বয়সেও মার খেয়েছে, তবুও নাম বলেনি। আস্থা কতটুকু থাকলে এমনটা করা যায়!
এই ফাঁকে আমি এক পা, দু’পা করে স্কুলের পেছন দিয়ে বাড়ি চলে গেলাম। পরে শুনেছি, যে ছেলেটার ‘আদালত’ বসিয়েছিলাম সে স্যারের কাছে আমার নাম বলে দিয়েছে। টিফিনের পর স্যার আমাকে ক্লাসরুমে খুঁজে গেছেন। পেলে ‘খবর করে দেবেন’— সেটাও বলে গেছেন। পরে স্যার আর মারেননি। হয়তো ভুলে গেয়েছিলেন। তবে স্যারের ‘মাইর আতঙ্কে’ আমরা ঠিকই মাসকার সকল কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছিলাম। খুব মনে পড়ে সেই দিনগুলো। এখন ‘মাসকা’ শুধুই স্মৃতির পাতায় গেঁথে আছে। অনেক বন্ধুদের হয়তো মনে আছে বা নেই।
বন্ধু দিবসে পুরনো স্মৃতি হাতরে এই গল্পতেই ডুবে গেলাম। সব বন্ধুরা ভালো থাকুক তাদের আপন কর্মে-নীড়ে। মাসকা, প্রাইমারি জীবনের কথিত আদালত।
লেখক: সাংবাদিক