ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণে ভেঙেছিল সংসার
আফরিন শাহনাজ || রাইজিংবিডি.কম
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক কিংবদন্তি নারী মমতাজ বেগম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী এ নারী ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে চরম লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হন এবং তাকে দীর্ঘদিন কারাবাসে থাকতে হয়। পঞ্চাশের দশকে অবরুদ্ধ সমাজের সমস্ত বাধা পেরিয়ে রাজপথে যেসব সাহসী নারীরা বেরিয়ে এসেছিলেন তাদের পথিকৃত ছিলেন মমতাজ।
মমতাজ বেগমের প্রকৃত নাম কল্যাণী রায় চৌধুরী। ১৯২৩ সালের ২০ মে কলকাতার হাওড়া জেলার শিবপুরে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রায় বাহাদুর মহিমচন্দ্র রায় এবং মা মাখন মতি দেবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী ছিলেন মামা। অত্যন্ত রক্ষনশীল পরিবারে বড় হওয়া সত্ত্বেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পরবর্তীকালে সিভিল সাপ্লাই অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নাফকে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হন। তখন তিনি কল্যাণী রায় থেকে মমতাজ বেগম হয়ে যান। কলকাতা ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ তার সংসার ভাঙার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৫২ সালে মমতাজ বেগম ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ছাত্র, শিক্ষকসহ সকল সাধারণ মানুষ মাতৃভাষার দাবিতে মিছিল করতে করতে রাজপথে নেমে আসে। ভাষা আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে যায় নারায়ণগঞ্জে। মমতাজ বেগম তখন সেখানকার তৎকালীন যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি মর্গান হাইস্কুলের কাছে রহমত উল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউটের সামনের ময়দানে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। জনসভা থেকেই জানা যায় ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি করা হয়েছে, বিশাল জনসভা তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তৎক্ষনাৎ সভা থেকে এক বিরাট মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে এবং মমতাজ বেগম এ মিছিলে যোগ দেন।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জের চাষারা মাঠে বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে মর্গান স্কুলের ছাত্রী, শিক্ষিকা এবং নারীদের প্রায় ৩০০ জনের দল মিছিলে অংশ নেয়। নারায়ণগঞ্জের আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো নারীসমাজের অংশগ্রহণ। নারীদের সংগঠিত করার এবং আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার সম্পূর্ণ কাজটাই করেছেন মমতাজ বেগম। তিনি আন্দোলন অব্যাহত রাখতে সেসময়ের রাজনীতিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক ও মতবিনিময় করেন। মমতাজ বেশ কয়েকবার আদমজী জুট মিলের শ্রমিকদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রেরণা যোগান। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে তিনি শাসক গোষ্ঠীর জন্য হুমকি হয়ে ওঠেন। তাই উচ্চমহলের নির্দেশে ২৭ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে স্কুলের তহবিল আত্মসাৎ-এর মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং ২৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
মর্গান গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষক এবং ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের এই নারকীয় সিদ্ধান্তে ক্লাস বর্জন করে বেরিয়ে আসেন। ক্ষুব্ধ জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাকে গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র, শিক্ষক, সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ, শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক সকলে একত্রিত হয়ে মিছিল নিয়ে কোর্টে হাজির হন। বিনা শর্তে তার মুক্তি দাবি করে, জনতা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে।
মহকুমা হাকিম ইমতিয়াজী তখন বাইরে এসে বলেন, মমতাজকে স্কুলের তহবিল তছরুপের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে তার গ্রেফতারের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু জনগণ তা বিশ্বাস করেনা। তাকে বিনাশর্তে মুক্তি না দিলে তারা আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে যাবে না, এ দাবি জানায়। পুলিশ তখন লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিকেলে পুলিশ মমতাজ বেগমকে নিয়ে ঢাকা রওনা হলে চাষারা স্টেশনের কাছে জনতা বাধা দেয়। উত্তাল নারায়ণগঞ্জবাসী চাষাড়া থেকে পাগলা পর্যন্ত রাস্তায় প্রায় ১৬০টি গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ফলে উভয়পক্ষে ৪৫ জন আহত হয়।
এই আন্দোলনের খবর ৩ মার্চ ভারতের ‘দ্যা স্টেটম্যান’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে সরকার নানান অপপ্রচার চালায়। এরই মধ্যে তার গ্রেফতারের দাবিতে সোচ্চার দু’জন ছাত্রী ইলা বকশী ও বেনু ধর সহ ১১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। কোর্টে মমতাজের জামিন আবেদন প্রত্যাখাত হলে বিক্ষোভ চরম আকার নেয়।
কর্তৃপক্ষ মমতাজ বেগমকে ক্ষমা প্রার্থনা এবং মুচলেকা প্রদানের মাধ্যমে মুক্তির শর্ত দেয়। তার স্বামী সেসময়ের ঢাকার খাদ্য পরিদর্শক আবদুল মান্নাফ মমতাজকে সে প্রস্তাব মেনে নিতে বলেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানালে আবদুল মান্নাফ তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দেন। প্রগতিশীল ও নির্ভীক মমতাজ বেগম তাতেও এ অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে রাজী না হলে আবদুল মান্নাফ তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে প্রায় দেড় বছর কারাবাসের পর মুক্তি পান মমতাজ বেগম। তবে তাকে নারায়ণগঞ্জ পৌর এলাকার মধ্যে অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৫৪ সালে মমতাজ বেগম আনন্দময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরে আহমেদ ভবানি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। আমৃত্যু শিক্ষকতা পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ৩০ জুন ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুবরণ করেন। ২০১২ সালে ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করে। তার সম্মানে নারায়ণগঞ্জের মর্গান হাইস্কুলের সামনের সড়কটির নাম ‘ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম সড়ক’ রাখা হয়।
লেখক: গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী
তারা//