আপোষহীন বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের ধাক্কায় পুলিশের কর্ডন ভেঙে যায়
আফরিন শাহনাজ || রাইজিংবিডি.কম
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন রওশন আরা বাচ্চু। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ভাষার দাবিতে ছাত্রীদের সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাঁর নেতৃত্বেই ইডেন মহিলা কলেজ এবং বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমাবেশ স্থলে সমবেত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে ঐতিহাসিক ছাত্রী মিছিল হয় রওশন আরা তাতে অংশগ্রহণ করেন। এই মিছিলে পুলিশের লাঠি চার্জে আহত হয়েছিলেন তিনি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রওশন আরা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা স্মরণ করে বলেন, “তখন বেলা ১০-১১টা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গণে আমতলায় জমায়েত হয়েছে। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্রসভা শুরু হয়েছে। তুমুল বিক্ষোভের মধ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের তর্ক-বিতর্ক চলছে। শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের স্বপক্ষে বিপুলসংখ্যক সংগ্রামী ছাত্রছাত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়া হলো। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই শ্লোগানে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সাফিয়া আপা, হালিমা ও আমি প্রথম দলে গেইটের কাছে আসি এবং প্রত্যেকটি ছাত্রী যাতে মিছিলে যোগ দিতে পারে সেই সুযোগ সৃষ্টিতে সাহায্য করি এবং তৃতীয় দলের সঙ্গে কর্ডন ভেদ করে মিছিলে যোগ দেই। আপোষহীন বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের ধাক্কায় পুলিশের কর্ডন ভেঙ্গে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পুলিশের লাঠি চার্জ ও কাদুনে গ্যাস নিক্ষেপ। কাদুনে গ্যাস ও লাঠি চার্জের মধ্যেই এসেম্বলী হলের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম।’
‘বেলা তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে পুলিশ অবিরাম গুলি ছুঁড়তে থাকে। মেডিকেলের উল্টো দিকে এস এম হলের প্রভোস্টের বাসা। তাঁর বাসার সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া। রাস্তার ধারে একটি রেস্টুরেন্ট, ২-১টি বইয়ের দোকান ও মুদির দোকান ছিল। রেস্টুরেন্টের এক কোণে অনেকগুলো ভাঙ্গা রিকশার স্তূপ পড়েছিল (বর্তমানে সে স্থানটি শহিদ মিনার)। কাদুনে গ্যাস আর গুলির মধ্যে বুঝতে পারছিলাম না কোন দিক থেকে গুলি আসছে তাই দৌড়ে গিয়ে ভাঙ্গা রিকশার স্তূপের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। কিন্তু সেটাও নিরাপদ মনে না হওয়ায় গুলির মধ্যেই কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে যাওয়ার মনস্থ করি। কিন্তু পার হওয়ার সময় কাঁটাতারের মধ্যে আমার শাড়ি আটকে যায়। কেউ আমার শাড়ি কাটা তার থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল। পিছন ফিরে তাকাবার সময় ছিল না। অবিরাম গুলি চলছে। ভেতরে তখন আহত সারা তৈফুর, সুফিয়া ইব্রাহিম, শামসুন নাহার রয়েছে। আহত অবস্থায় একজন অন্যজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। ওরা আমাকে দেখে বিচলিত হয়ে গনি সাহেবের বাড়ি থেকে পানি চেয়ে এনে খাওয়াল। কার কি হয়েছে সে দিকে হুঁশ নেই। আমরা সকলেই আতঙ্কগ্রস্ত। এরপর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী আমাদেরকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন।’
রওশন আরার জন্ম ১৭ ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে সিলেটের মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার উছলাপাড়া গ্রামে । তিনি ১৯৪৭ সালে পিরোজপুর গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে দর্শনে অনার্স করেন। ১৯৬৫ সালে বি এড ও ১৯৭৪ সালে ইতিহাসে এম এ করেন। তিনি গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ ফ্রন্টের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন যেমনঃঢাকার আনন্দময়ী স্কুল, লিটন অ্যাঞ্জেলস, আজিমপুর গার্লস স্কুল (খণ্ডকালীন), নজরুল একাডেমি, কাকলি হাই স্কুল এবং পরে আলেমা একাডেমিতে। সবশেষে ২০০০ সালে বিএড কলেজে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। রওশন আরা বাচ্চু ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী
তারা//