ঢাকা     শনিবার   ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১ ১৪৩১

২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার সমাবেশের একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন শাফিয়া খাতুন

আফরিন শাহনাজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১১:০৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার সমাবেশের একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন শাফিয়া খাতুন

ড. শাফিয়া খাতুন (১৯৩১-১৯৯৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ও নির্দেশনা বিভাগের চেয়ারম্যান ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য ছিলেন। তিনি রোকেয়া হলে প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

শাফিয়া খাতুন ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫১-৫২ শিক্ষাবর্ষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন্স স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ভিপি ছিলেন। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি বার লাইব্রেরি হলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের তিনি সদস্য ছিলেন। সেই সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী নিবাস ‘চামেরী হাউজ’-এ (বর্তমান রোকেয়া হলের পাশে) থাকতেন। তিনি  বিভিন্ন সময়ে ঐ হোস্টেলে ছাত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন ও ছাত্রীদের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করতে আহ্বান জানান। যারা তাঁর সঙ্গে ছাত্রীদের সংগঠিত করার কাজে ও আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন সুফিয়া আহমদ, রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর মাহমুদ, শামসুন্নাহার আহসান, মাহফিল আরা প্রমুখ।

ড. শাফিয়া খাতুন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘উইমেনস স্টুডেন্টেস ইউনিয়নের ভিপি হিসেবে আমি শুধু ছাত্রীদের সংগঠিত করার দায়িত্বই পালন করতাম। ছাত্রীদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে মেয়েদের স্কুলে পাঠাই। তখন ছাত্রীদের মাঝেও এমন উৎসাহ লক্ষ্য করেছি যে, তা কোনো দিন ভুলবার নয়। পায়ে হেঁটে মেয়েরা বাংলা বাজার গার্লস স্কুল ও কামরুননেছা গার্লস স্কুলে গিয়ে একুশে ফেব্রুরারির আমতলার সভায় যোগ দেয়ার জন্য ছাত্রীদেরকে সংগঠিত করেছে। একুশের আন্দোলনকে সফল করার পেছনে এসব তৎপরতা অপরিসীম অবদান রেখেছে।’

আরো পড়ুন:

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট চলাকালীন মিছিলে সেদিন নেতৃত্ব দেন তিনি। মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের মিছিলের সাথে মিলিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবন অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ভাষার দাবিতে ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী চলমান আন্দোলনের প্রায় প্রতিটি সভা ও সমাবেশে শাফিয়া খাতুনকে আপোষহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়। সরকার কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে। এই অবস্থায় ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা বা না-করার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্তের জন্য বৈঠক হয় সেখানে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তবে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা তাকে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন এবং তিনি যথাসময়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্যে অবস্থান নেন।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রজনতার সমাবেশকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য ছাত্রীদের একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন শাফিয়া খাতুন। ড. শাফিয়া খাতুন বলেন, ‘আমতলার মিটিং শেষে চারজন চারজন করে বের হওয়ার জন্য ব্যাচ করা হলো। আমরা ছিলাম ৩য় ব্যাচে। ছাত্ররা বের হতেই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। ছাত্রদের দুটি গ্রুপকে গেইটের বাইরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ট্রাকে তুলে নেয়। তারা মিছিল করে এগিয়ে যেতে পারেনি। আমরা চারজন করে দূরত্ব রেখে বের হলাম। গেটের পাশে পানিভর্তি একটা বালতি রাখা ছিলো। সবাইকে বলা হয়েছিলো, রুমাল ভেজিয়ে নেয়ার জন্য। কাঁদানে গ্যাস হতে চোখ রক্ষার জন্য প্রয়োজন হতে পারে।

আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ এগিয়ে আসছিল বাধা দেয়ার জন্যে। পাশে থেকে ওদের কোনো অফিসার বোধ হয় বললেন- ‘ছোড় দো’। আর বাধা পেলাম না।  ইতিমধ্যে বেশ কিছু দূর এগিয়েছি। কিছুটা মিছিলের আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ আমাদের ছাত্রীদের ব্যাচই প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এগিয়ে যায়।’

পুলিশ তাদের দলটিকে গ্রেপ্তার করেনি তবে কয়েকজনকে লাঠিপেটা করে। পুলিশের লাঠিপেটায় এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার ফলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং রওশন আরা বাচ্চু পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন। টিয়ার গ্যাসের শেল শাফিয়া খাতুনের পায়ের কাছে এসে পড়ে। টিয়ার গ্যাসের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় তিনি চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন না। রওশন আরা ও শাফিয়া খাতুনকে ঢাকা মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

মেডিকেল থেকে বেরিয়ে এসে তিনি আবার ছাত্রীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। দেখেন বর্তমান শহিদ মিনারের পেছনে ছাত্র-পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। এরপর শাফিয়া খাতুন সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনের পাশে অবস্থিত ড. গনির বাসভবনে গিয়ে দেখতে পান সেখানে বেশ কয়েকজন ছাত্রী অবস্থান করছে। তিনি তাদের নিয়ে পুনরায় মিছিল করে বের হন। মিছিলটি সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনের পাশ দিয়ে টিএসসি ঘুরে রেসকোর্স মাঠ বরাবর চলে যায়। তারা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে আকাশ প্রকম্পিত করেন। মিছিলটি এক পর্যায়ে পুলিশের সামনে পড়ে। কিছু স্কুল ছাত্রীকে পুলিশ ধরে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং টঙ্গী এলাকায় নিয়ে ছেড়ে দেয়। তারা রেল লাইন ধরে হেঁটে নিজ নিজ বাড়ি পৌঁছায়। আর বাকিরা মিছিল বন্ধ করেন না। বাংলা একাডেমির (তৎকালীন নূরুল আমিনের সরকারি বাসভবন) সামনে দিয়ে মিছিলটি প্রদক্ষিণ করে ঢাকা মেডিকেলের মূল ফটকে এসে শেষ হয়।

গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়