ঢাকা     সোমবার   ০১ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৭ ১৪৩১

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন : এক নির্ভীক সংগ্রামী প্রাণ

আফরিন শাহনাজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৩:১৮, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩
শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন : এক নির্ভীক সংগ্রামী প্রাণ

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। ঢাকার বাতাসে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের ঘ্রাণ। কিন্তু বাতাসে লাশের গন্ধ সেই বিজয়ের ঘ্রাণ ছাপিয়ে যায়। রায়েরবাজার ও মিরপুরের জলাভূমিতে খোঁজে মেলে অনেকগুলো মরদেহের। আবিষ্কৃত হয় বধ্যভূমি। পিছমোড়া করে হাত বাঁধা, আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা, গুলিতে ঝাঁঝরা, বেয়নেটে ক্ষত— বিক্ষত, অর্ধগলিত এই মরদেহগুলো ছিল সেইসব স্বাধীনতাকামী বাঙালি শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পী, সাংবাদিকসহ অন্যান্য পেশার আলোকিত জনের; যারা অবরুদ্ধ থেকেও বাঙালির মুক্তি—  সংগ্রামকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছিলেন। এ রকম প্রায় দুইশ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসে নির্মমভাবে অত্যাচারের পর হত্যা করা হয়। 

১৭ ডিসেম্বর সেইসব মেধাবী ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা রায়ের বাজারে ছুটে গিয়েছিলেন নিখোঁজ প্রিয়জনকে শনাক্ত করতে। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে যারা নিহত বুদ্ধিজীবীদের লাশ শনাক্ত করতে গিয়েছিলেন তারা সহজেই যে লাশটি চিনতে পেরেছিলেন সেটি ছিল সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের। পরনের সাদা শাড়ি, সাদা স্কার্ফ, পায়ে সাদা জুতা-মোজা দেখে তাকে শনাক্ত করা যায়। কারণ ফরসা, ভরাট মুখের সেলিনা পারভীন সব সময় সাদা শাড়ি পরতেন। শীতকালে সবসময় পায়ে মোজা পরতেন। ১৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় যখন কয়েকজন এসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাক পড়েছে বলে ধরে নিয়ে গেলো, তখনও সাদা জুতা-মোজা ও সাদা স্কার্ফ পরে বের হয়েছিলেন বাসা থেকে। উল্লেখ্য, রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার হওয়া একমাত্র নারী মরদেহটি ছিল সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের।

তাঁর একমাত্র ছেলে প্রয়াত সুমন জাহিদ মাকে নিয়ে এক স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘মাকে যখন আলবদর বাহিনীর লোকেরা আমার সামনে থেকে চোখ বেঁধে অপহরণ করে নিয়ে যায়, সেটাই তাঁর শেষ যাওয়া। সেটা ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর দুপুরবেলা। মাকে আর দেখিনি। মা ফিরেও আসেননি।’

এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ও আশ্চর্যজনকভাবে রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে পালিয়ে বেঁচে আসা মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে সুমন জেনেছিলেন মৃত্যুর আগে তাঁর মা অনুনয় বিনয় করে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন। 

‘দীর্ঘ সময় তাঁদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এবং শেষ মুহূর্তে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়েছিল। সেই সময় আমার মাসহ সবাই বুঝে ফেলেছিলেন, এই হয়তো তাঁদের জীবনের শেষ মুহূর্ত। মা তখন ওদের অনুনয়, বিনয় করছিলেন তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বলেছিলেন, ‘ঘরে আমার আট বছরের একটা সন্তান আছে, ও না খেয়ে আছে। ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। শুধু এই শিশুটির কথা চিন্তা করে আমাকে ছেড়ে দাও।’ লিখেছেন সুমন।

হায়েনারা তাদের বন্দুকের বেয়নেট চার্জ করে মায়ের মুখ ফেঁড়ে দেয়। তিনি তখন আরও জোরে চিৎকার করতে থাকেন। কথা অস্পষ্ট হয়ে যায়, তারপরও যতটুকু বোঝা যায়, তিনি বলতে থাকেন, ‘আমি আর এই শহরে থাকব না, লেখালেখি করব না। ছেলেকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব।’ তাতেও আলবদর বাহিনীর ওই নরপিশাচদের এতটুকুও করুণা হয়নি, বরং বেয়নেট চার্জ করে এবং গুলি করে মাকে তারা হত্যা করে।’

সেলিনা পারভীনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় প্রখ্যাত নারী অধিকারকর্মী মালেকা বেগমের স্মৃতিচারণায়। তিনি লিখেছেন: 
‘১৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় কয়েকজন এসে বলল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাক পড়েছে, যেতে হবে। সুমন (সেলিনা পারভীনের একমাত্র ছেলে) তখন ৮ বছর বয়সের ছিল। সব স্মরণ আছে তার। বলেছে তেল মাখিয়ে মা তাকে মামার সঙ্গে ছাদে পাঠিয়ে মোড়ায় বসে রান্না করছিলেন। বললেন পরে যাবেন কারফিউ শেষ হোক। ওরা সুযোগ দিল না। সুমন চেয়েছিল সঙ্গে যেতে। অনুমতি মেলেনি।’

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন ছিলেন সাহিত্য পত্রিকা ‘শিলালিপি’র সম্পাদক। এছাড়াও কাজ করেছেন সাপ্তাহিক ‘বেগম’ ও সাপ্তাহিক ‘ললনা’ পত্রিকায়। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার পাশাপাশি ভীষণভাবে রাজনীতি সচেতন ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকায় সম্পাদকের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে যোগ দেন সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সাপ্তাহিক ‘ললনা’ পত্রিকায়। তিনি এই পত্রিকার প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করতেন। একইসঙ্গে পত্রিকাটির বণিজ্যিক তথা বিজ্ঞাপন বিভাগের দেখভালের দায়িত্বও ছিল তাঁর উপর। ‘ললনা’র পরিবেশ ছিল গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতার সমর্থনপুষ্ট।

খ্যাতমান চিত্রশিল্পী হাশেম খান সেলিনা পারভীন সম্পর্কে এক স্মৃতিচারণে বলেন, “ ‘ললনা’ গ্রুপে আমাদের সবার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধেয় সেলিনা আপা। ‘ললনার’ বাণিজ্যিক দিক বিশেষ করে বিজ্ঞাপন দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তাঁর হাতে। ভালো লেখা জোগাড় করা এবং মাঝে মাঝে বিশেষ প্রতিবেদন সংগ্রহ করে পত্রিকার মান উন্নত করার চেষ্টা করেছেন সব সময়। ম্যানেজিং এডিটর মুহম্মদ আখতার অত্যন্ত নিষ্ঠা নিয়ে ‘ললনা’ গ্রুপকে সব সময় সক্রিয় রেখে ষাটের দশকের শেষের দিকে দেশে গণআন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। অবশ্য ‘ললনা’ পত্রিকার পরিচালনা বোর্ডের প্রধান তৎকালীন খ্যাতিমান বাঙালি প্রকৌশলী জনাব আব্দুল জব্বার, বোর্ডের অন্যতম সদস্য সৈয়দ শাহজাহান, আবদুস সাত্তার ও প্রধান সম্পাদিকা ফৌজিয়া আক্তার— এঁদের উদার মনোভাবের কারণেই ললনা গ্রুপ বাঙলা সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্য চর্চাকে আন্দোলনে রূপ দিতে পেরেছিল। ফলে তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকার এবং তাদের দালাল আলবদর ও রাজাকাররা ‘ললনা’ সাপ্তাহিককে কখনোই পছন্দ করতে পারেনি।

‘ললনা’য় কাজ করার সময়ই সেলিনা পারভীন নিজের সম্পাদনায় বের করেন ‘শিলালিপি’ সাহিত্য পত্রিকা। শোনা যায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে অন্যতম পাক সেনা প্রধান রাও ফরমান আলী সেলিনা পারভীনকে পত্রিকার লেখক কবি ও প্রচ্ছদে বাংলা লোকশিল্পের অলঙ্কার দেখে— এসব অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং আরো পরামর্শ দিয়েছিলেন পাক সামরিক নির্দেশ মতো পাকিস্তানি ভাবধারার লেখা ও ছবি দিয়ে ‘শিলালিপি’ প্রকাশ করা হোক। সেলিনা পারভীন সেই নির্দেশ ও পরামর্শ পালন করতে পারেননি। ফলে পরিণতি যা হাওয়ার হলো— আলবদর বাহিনী কর্তৃক নৃশংসভাবে হত্যা। মুহম্মদ আখতারের পরিণতিও হলো একই। তাঁকেও আলবদর বাহিনী ১২ ডিসেম্বর ’৭১ তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।”

১৯৭১ সালে যখন ‘ললনা’ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়, সে সময় সেলিনা পারভীন তাঁর নিজের পত্রিকা ‘শিলালিপি’ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার আগে ললনায় কাজ করার সময়ই তিনি বের করেছিলেন এই শিল্পসাহিত্য বিষয়ক সাময়িকী। ষাটের দশকের সব বিখ্যাত লেখকদের লেখা ‘শিলালিপি’তে ছাপা হতো। পাশাপাশি তরুণ লেখকদের লেখাও নিয়মিত প্রকাশ করতেন। ‘ললনা’য় তিনি বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করতেন বলে ‘শিলালিপি’র জন্য বিজ্ঞাপন পেতে তাঁকে খুব বেগ পেতে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। তাদের অর্থ, ওষুধপথ্য ও শীতবস্ত্র ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দেন। ’৭১ এর মার্চ মাসে ঠিক করেছিলেন স্বাধীনতার বাণী নিয়ে প্রকাশ করবেন ‘শিলালিপি’। প্রস্তাবিত প্রচ্ছদ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। শিলালিপির সে সংখ্যাটি আর প্রকাশ করা হয়নি সেলিনা পারভীনের।

লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ১৯৬৮ সালে ‘ললনা’র মাধ্যমেই সাংবাদিকতার শুরু করেন, সেখানে কাজ করেছেন দু’বছর। সেলিনা পারভীনের সাথে তাঁর পরিচয় ‘ললনা’র অফিসে। শাহরিয়ার কবির সেলিনা পারভীনকে নিয়ে স্মৃতিকথায় লিখেছেন: 

‘‘একাত্তরের ডিসেম্বরে কলকাতায় বসে যখন ‘ললনা’র মোহাম্মদ আখতার আর সেলিনা পারভীনের হত্যার সংবাদ পেলাম তখন মনে হয়েছিল তারা তো রাজনীতির সঙ্গে সেভাবে যুক্ত ছিলেন না। তাদের কেন হত্যা করা হলো? পরে মনে হলো ‘ললনা’র সঙ্গে যুক্ত থাকাটাও আলবদরের ঘাতক বাহিনীর কাছে কম অপরাধের ছিল না। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে ‘ললনা’ শুধু পত্রিকা হিসেবেই যে আন্দোলনের দর্পণ ছিল তা নয়, প্রতিবাদী লেখক, শিল্পীদের মিলিত হওয়ারও গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। ... ললনার দিনগুলোর কথা মনে হলেই আখতার ভাইর পাশে সেলিনা আপার মুখ ভেসে ওঠে স্মৃতির পাতায়। সাদা শাড়ি পরা, শান্ত, সাহসী, ব্যক্তিত্বময়ী একজন নারী, সংসারের যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একা লড়ছেন সুমন নামের ছয় বছরের শিশুটিকে মানুষ করার জন্য, যার আয়ত চোখে মমতা আর বিষণ্নতা মাখা।”

'একটি ক্লীব কোমল
বিশ্রামের চেয়ে
বলিষ্ঠ মৃত্যু
অনেক মহৎ ...'

সাংবাদিক সেলিনা পারভীন শিলালিপিতে লেখা তাঁর এই কবিতার লাইনগুলোর মতোই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন দৃঢ়ভাবে, মাথা উঁচু করে। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করা হয়।

তথ্যসূত্র:

১. মো. সুমন জাহিদ: মায়ের ছবি দেখে, প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫)

২. রশীদ হায়দার সম্পাদিত: স্মৃতি ১৯৭১,দ্বিতীয় খণ্ড, ২০১৭—১৮) বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৯৩

৩. হাশেম খান: সেলিনা পারভীন কিছু স্মৃতি, ভোরের কাগজ, ২৯ মার্চ, ২০১৯

৪. শাহরিয়ার কবির: সেলিনা আপার স্মৃতি অমলিন,  ভোরের কাগজ, ২৯ মার্চ, ২০১৯

লেখক : গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী


 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়