ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

শুভ জন্মদিন শহিদ আলতাফ মাহমুদ

শাওন মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩  
শুভ জন্মদিন শহিদ আলতাফ মাহমুদ

ভাষা আন্দোলনের অবিস্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ কালজয়ী এই গানের সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ। ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মুলাদী থানার অন্তর্গত পাতারচর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আলতাফ মাহমুদ। বাবা নাজেম আলী হাওলাদার এবং মা কদবানুর একমাত্র পুত্র সন্তান আলতাফ মাহমুদ।

১৯৫০ সালে ধূমকেতু শিল্পী সংঘ - সংগঠনের সাথে যুক্ত হন তিনি। ’৫২-র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আলতাফ মাহমুদ ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী। আলতাফ মাহমুদ যত গান সৃষ্টি করেছেন তার সবই দেশ, মা ও মাটিপ্রেম মেশানো। সময়টা ছিল স্বাধিকারের জন্য জাতিকে উজ্জীবিত করার। যার ফলে আলতাফ মাহমুদ সুরে সুরেই জাতির হৃদয়ে স্পন্দন তুলতে পেরেছিলেন। ১৯৬৬ সালের মধ্যেই শিল্পী আলতাফ মাহমুদ সুরারোপ, কণ্ঠদান এবং সঙ্গীত পরিচালনায় পূর্ণ প্রতিষ্ঠালাভ করেন। ‘তানহা’ ছায়াছবিতে আলতাফ মাহমুদ প্রথম এককভাবে সঙ্গীত পরিচালক হয়ে কাজ করেন। তাছাড়া  ‘বেহুলা’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘ক খ গ ঘ’, ‘কুঁচবরণ কন্যা’, ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন এবং প্রথম দুইটিতে অভিনয়ও করেন তিনি। ‘বাঁশরী’ ছবিতেও অতুলপ্রসাদের ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’ গানটি সহ বহু চলচ্চিত্রে কণ্ঠদান করেন।

১৯৭১ সালে বেহালা, তবলা, হারমোনিয়মের সাথে আলতাফ মাহমুদের হাতে উঠে আসে রাইফেল। শহরের যেখানেই মিছিল আর আলোচনা অনুষ্ঠান হয় সেখানেই আলতাফ মাহমুদ উপস্থিত থাকেন। শহীদ মিনারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিচালনা ও কণ্ঠদান করেন তিনি। সেই সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ঠিক বিপরীত দিকে ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী তাদের মারণাস্ত্র দিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের টিনসেডগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়।

২৬ তারিখ সকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। ২৭ মার্চ কয়েক ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আলতাফ মাহমুদ সবাইকে নিয়ে কমলাপুরের বৌদ্ধবিহারে আশ্রয় নেন। সেখানে ১৮ দিন থাকার পর আবার চলে আসেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাসায়। এখানে ফিরে এসে তিনি বিচলিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। দেশ, আত্মীয়-স্বজন এবং জনগণের দুরবস্থার কথা ভেবে অস্থিরতায় কাটে তার সময় এবং এ সময়ই তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ঢাকা শহরে কতগুলো অপারেশনে ক্র্যাক প্লাটুনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি অপারেশন হয় আলতাফ মাহমুদের অংশগ্রহণে।

আগস্টের শেষ সপ্তাহে স্থির করেন, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন; চলে যাবেন পশ্চিমবঙ্গে এবং সেখান থেকে কাজ করবেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। কারণ তার আগেই বন্দি হন পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে। তাদের প্ল্যাটুনের একজন গেরিলা ধরা পড়েন। তাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তিনি আলতাফ মাহমুদের বাসার লেবু গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের কথা বলে দেন।

বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী যখন তাদের নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পারে, তখন এ জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য ইতিহাসের বর্বরতম বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করে। ৩০ আগস্ট ভোরবেলা আর্মীরা প্রথমে আলতাফ মাহমুদের পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এরপর কয়েকজন ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে, 'আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?' আলতাফ মাহমুদ জবাব দিলেন, 'আমি'। এরপর আর্মীরা তাকে দিয়ে মাটি খুঁড়ে লেবু গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের ট্রাঙ্ক দুটি বের করে। পরে তাকেসহ বাসার সব পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। রাতে রমনা থানা আর সারা দিন নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলের টর্চার সেলে নির্যাতন করে। দুই দিন ধরে বর্বর অত্যাচারেও আলতাফ মাহমুদ ক্র্যাক প্লাটুনের কোনো সদস্যর নাম বলেননি। বরং সাথে ধরা পড়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সব দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর তাদের মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এদিনের পর আলতাফ মাহমুদকে কেউ আর খুঁজে পাননি।

একাত্তরে লড়াইয়ে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকরা তাঁবেদার সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি আলতাফ মাহমুদকে অকথ্য নির্যাতনের মাধমে কাবু করতে চেয়েছিল। পিশাচেরা যতই যাতনা বাড়িয়েছে তার রক্তমাংশের দেহের ওপর, ততই যেন ইস্পাতদৃঢ় আদর্শ মানুষ, অনুকরণীয় চরিত্র আর অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন তিনি। তাই আলতাফ মাহমুদ আজ একটি জ্বলন্ত নাম, বারুদের মতো ছড়িয়ে আছে এ দেশের পথে-প্রান্তরে কোটি কোটি হৃদয়ের উষ্ণ আবাসে।

শুভ জন্মদিন শহিদ আলতাফ মাহমুদ।

/স্বরলিপি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ