ঢাকা     সোমবার   ০১ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৭ ১৪৩১

শয়তানের কাছে প্রার্থনা করেন তারা

সাতসতেরো ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪১, ৫ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১১:৫০, ৫ জানুয়ারি ২০২৪
শয়তানের কাছে প্রার্থনা করেন তারা

পেশায় খনি শ্রমিক। এই খনি পৃথিবীর অন্যান্য খনিগুলো থেকে আলাদা। জানা যায়, এখানে যারা কাজ করেন তারা ৪০ বছর বয়সের বেশি বাঁচেন না। খনিটি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায়। পর্বতের নাম সেরে রিকো।

বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বলিভিয়ার সেরো রিকো পর্বত মৃত্যুর ফাঁদ হিসেবে পরিচিত। এই পর্বতে রয়েছে ৫০০ বছর বয়েসী খনি। যা এক সময় স্প্যানিশ সম্রাজ্যকে সমৃদ্ধ করেছিল। পর্বতগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছে। এই পর্বতের শ্রমিকরা নিজেদের রক্ষা করার জন্য শয়তানের কাছে প্রার্থনা করে।

বলিভিয়ার এই পর্বতমালা পরিচিত ‘রিচ মাউন্টেন’ নামেও। সেরো রিকোর আক্ষরিক অর্থও তাই, ‘ধনী পর্বতমালা’। এর উচ্চতা প্রায় ১৫ হাজার ফুট। মূল পর্বত ছাড়াও আশপাশে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় পর্বত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে মাটির নীচে তলিয়ে যাচ্ছে  রিকো পর্বতমালা। ষোড়শ শতকের বিত্তশালী পোতোসি এখন বলিভিয়ার অন্যতম দরিদ্র শহরে পরিণত হয়েছে। সেই শহরের ৪০ শতাংশই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন। এই পর্বতে বিভিন্ন আকরিকের মধ্যে সব থেকে বেশি পাওয়া যায় রুপা।  এছাড়াও টিন, দস্তা এবং সীসা পাওয়া যায়। ১৫৪৪ সালে দিয়েগো ওয়ালপা নামে এক স্থানীয় চাষি রুপার খনির খোঁজ পেয়েছিলেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে স্পেনের ধনী ব্যবসায়ীরা এসে আসর জমান পোতোসি শহরে। শহরেরই কেচুয়া উপজাতির মানুষদের খনির শ্রমিক বানিয়ে চলতে থাকে খননকার্য। প্রায় ১৩ হাজার স্থানীয় মানুষ খনিতে শ্রমিকের কাজ নেন।

আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস এনে খনির শ্রমিক বানানো হয়। সুড়ঙ্গে খনির গাড়ি চলার জন্য লাইনও পাতা হয়। অকথ্য অত্যাচারেরও শিকার হতে থাকেন খনির শ্রমিকরা। খনিতে কাজ করার সময় বহু শ্রমিকের মৃত্যুও হত। আর সেই কারণে সেরো রিকোর নাম হয়ে যে, ‘মাউন্টেন দ্যাট ইটস্ ম্যান’, অর্থাৎ ‘নরখাদক পর্বত’।
২০০ বছর ধরে সেই শহরে স্পেনীয় রাজত্ব চলে। মনে করা হয়, সেই সময় সেরো রিকো থেকে সাড়ে তিন কোটি কিলোগ্রামেরও বেশি রুপা খনন করে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে, বিশ্বের ৮০ শতাংশ রুপোর সরবরাহ এই খনি থেকেই আসত। এরও প্রায় ১০০ বছর পর বলিভিয়ায় স্পেনীয় রাজত্বের অবসান হলে সেরো রিকোর দখল নেয় সে দেশের খনি সংস্থা ‘কোমিবল’। উদ্দেশ্য ছিল আরও রুপা বের করে আনা। এতে বিশেষ লাভ হয়নি। কারণ, স্পেনীয়রা ততদিনে যে রুপা ছিল তা লুট করে নিয়েছে। সেরো রিকোয় বিশেষ রুপা আর অবশিষ্ট ছিল না।


১৯৮০-র দশকে রুপার দামে পতন আসে। রিকোর দায়িত্ব স্থানীয়দের হাতে তুলে দেয় ‘কোমিবল’। স্থানীয় কয়েকটি কোঅপারেটিভ সেখানে খননকার্য চালায়। এখনও পোতোসি শহরের প্রায় ১৬ হাজার মানুষ খনির শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। রুপা সেভাবে আর পাওয়া না গেলেও টিন, দস্তা আর সীসার খোঁজে মেলে। ২০২১ সালে বলিভিয়ার এই খনি থেকে ১৩০ কোটি ডলারের দস্তা বিক্রি হয়েছে। খনিতে প্রবেশের আগে মূল সুড়ঙ্গের মুখে রাখা এক মূর্তিতে পুজা করেন শ্রমিকেরা। এই মূর্তিটি ‘এল থিয়ো’ বা ‘আঙ্কল’নামে পরিচিত। খনির মুখে থাকা শিংওয়ালা ওই মূর্তি কোকা পাতা, মদ এবং লামার রক্ত দিয়ে পুজা করা হয়। মনে করা হয়, খনি শ্রমিকদের ভয় দেখানোর জন্য সেই ‘শয়তানের মূর্তি’ সেখানে বসানো হয়েছিল। ভয় থেকে বাঁচতে এই মূর্তিকেই পুজা করেন শ্রমিকেরা।

ধস নেমে মৃত্যুর পাশাপাশি সিলিকোসিস নামে ফুসফুসের এক রোগে আক্রান্ত হয়েও অনেকে মারা যান। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, খনন করে করে সেরো রিকো ফাঁপা হয়ে গিয়েছে। এই পাহাড় বাইরে থেকে নিরেট হলেও ভিতর অন্তঃসারশূন্য।  ২০১১ সালে সেরো রিকোতে একটি ‘সিঙ্কহোল’ দেখা গিয়েছিল। সিমেন্ট দিয়ে তা ভরাট করা হয়। সমীক্ষা বলছে, সেরো রিকো পর্বত প্রতি বছর কয়েক সেন্টিমিটার করে ডুবে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে সেরো রিকো এবং পোতোসি শহরকে বিপন্ন এলাকার তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে।

সেরো রিকোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বর্তমানে বলিভিয়ার খনি সংস্থা ‘কোমিবল’কে।  

স্বরলিপি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়