ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

আমাদের একজন মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন

সাতসতেরো ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১০:২৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
আমাদের একজন মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন

পুরো নাম মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই নামটি সংগ্রাম ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নুরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে প্রতিবাদ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ৩টায় পূর্ববঙ্গ পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার মাত্র ঘণ্টা কয়েক আগে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে অধিবেশন স্থগিত রাখার দাবি জানান আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। 

একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে আইন পরিষদে প্রথম বক্তব্য দেন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। অধিবেশনে তার দেওয়া বক্তব্য , ‘জনাব স্পিকার সাহেব, প্রশ্নোত্তরের পূর্বে আমি আপনার কাছে একটা নিবেদন করতে চাই। যখন দেশের ছাত্ররা, যারা আমাদের ভাবী আশা-ভরসাস্থল, পুলিশের গুলির আঘাতে জীবনলীলা সাঙ্গ করছে, সেই সময় আমরা এখানে বসে সভা করতে চাই না। প্রথমে ইনকোয়ারি তারপর হাউস চলবে।’ 

এক নজরে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ:
মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (১৯০০-১৯৮৬)  রাজনীতিক। তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার তরুটিয়া গ্রামে ১৯০০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় ডায়মন্ড জুবিলী হাইস্কুলে এন্ট্রান্স ক্লাসে অধ্যয়নকালে তিনি খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২০-২২) যোগ দেন। এ সময় তিনি সভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আন্দোলনের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলেন এবং সলঙ্গাহাটে কংগ্রেসের অফিস প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২২ সালে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে এক কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হলে তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত হন। 

উত্তর ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করেন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। লাহোরের এরশাদ ইসলামিয়া কলেজে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সেরা বাগ্মীর স্বীকৃতি লাভ করার পরে তিনি ‘তর্কবাগীশ’ হিসেবে পরিচিত হন।

তিনি ১৯৩৬ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট করেন এবং পরে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। 

১৯৫৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেফতার হওয়ার পরে সে বছর ১ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন। পরে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। 

১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালে যথাক্রমে মারি ও লাহোরে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করে তিনি বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।আওয়ামী লীগ তখন ছয়দফা-পন্থি ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)-পন্থি এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সালে তিনি পিডিএম-পন্থি আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার এডহক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনের পর তিনি ছয়দফা-পন্থি আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি পাবনা-২ আসন থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে তিনি মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ অধিবেশনে মাওলানা সভাপতিত্ব করেন। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 

বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর মাওলানা তর্কবাগীশকে স্বপরিবারে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মোশতাক সরকার তাদের নিজ রচিত স্টেটমেন্ট প্রকাশ করেন। বলা হয়ে থাকে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশই প্রথম নেতা যিনি আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কবর জিয়ারত করেন। ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি গণ আজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং এ দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। 

এরপর ১৯৮৩ সালের ৩০ জানুয়ারি তার সভাপতিত্বে ১৫টি রাজনৈতিক দলের এক যৌথসভায় ১৫ দলীয় জোট গঠিত হয়। জোটের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে তিনি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা রাখেন।

মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন। ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট ঢাকায় তার মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র: রোজিনা কাদের, বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া

/লিপি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়