ঢাকা     শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১২ ১৪৩১

প্রিয় চট্টলা, গম আছন্নি 

দিলরুবা আহমেদ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩৯, ৪ মার্চ ২০২৪  
প্রিয় চট্টলা, গম আছন্নি 

২০২২ সালের ১২ নভেম্বর, সকালবেলা। প্রায় ১১টা বেজে গেছে। আমি দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছি। উঠেই তৈরি হয়ে গেলাম, বেরুবো চট্টগ্রাম শহরে ঘুরতে। প্রাণ চাইছে ঘুরে বেড়াতে, এলোমেলোভাবে, যেখানে যেতে মন চায় সেভাবে ঘুরব। ওদিকে আম্মা তার বাড়ির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত। এ বাড়িতে এলেই আমার আম্মা খুব খুশিতে থাকেন। অনেক আনন্দ যেন সারাক্ষণ ছুঁয়ে থাকে তাকে। এখানকার সব কিছু তাঁর বড় পছন্দের। আমাদের তিন ভাই বোনকে আর আমাদের জনককে নিয়ে তাঁর বহুদিনের সংসার ছিল এখানে। এখন আমরা কেউ আর নেই, কেবল সংসার পরে আছে খালি হয়ে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বহু আগে এই বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। আগের জামানাতে এখনকার মতো বিল্ডার্স ছিল না। সব তাঁরা রাজমিস্ত্রী নিয়ে নিজস্ব পরিচালনায় নিজ হাতে নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে গড়তেন। খুঁজলে হয়তো দেখা যাবে কোনো কোনো ইট নিজেই নির্দেশ দিয়ে দিয়ে সোজা করে বসিয়েছিলেন। হয়তোবা নিজেই হাত দিয়ে সজোরে একটা ইট ঠুকে দিয়েছেন আরেকটা ইটের উপর। হয়তোবা নয়, এটিই সত্য। না হলে এতো কেন ভালো লাগা তাঁর এই বাড়ি ঘিরে! আমি তার মমতা অনুভব করি। রীতিমত দেখতে পাই। তার চলনে বলনে হাটায় ভঙ্গিমায় এই আনন্দ যেন ফুটে ওঠে। প্রফুল্ল মনে তাঁর আঙিনাময় ঘুরে বেড়ানো আমাকেও আনন্দিত করে।

চেয়ে দেখলাম আমার জন্য প্রচুর নাস্তা বানানো হয়েছে বা আনানো হয়েছে। ফ্লাক্সে করে চা বানিয়ে রাখা হয়েছে। দারোয়ানের পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর বয়সী বৌ আমাকে দেখে হেসে জানতে চাইলো- কুঁরি কুরা (মুরগি) না রাতা কুরা (মোরগ), কোনটা আমার জন্য আনবে বাজার থেকে? আমি না বুঝে চেয়ে আছি দেখে আম্মা বললেন, ওর কি এতো কিছু মনে আছে নাকি? বিদেশে থাকে। দারোয়ানের বৌ সাথে সাথে জানান দিলো তার দশম শ্ৰেণীর ‘ফোয়া’ (পুত্র) ইংরেজি জানে। এবার দোভাষী নিয়ে সে আমার চারদিকে ঘোরাঘুরি শুরু করলে তো মহা কেলেঙ্কারি! যদি রটে, বাংলা সাহিত্যপ্রেমী একজন বিদেশ থেকে এসে ভাষা বুঝার জন্য ভায়া মিডিয়াতে এগুচ্ছে, কেলেঙ্কারিময় খবর হবে সেটি। তাই নয় কি! 

গুগল ঘেটে দেখে নিয়েছি ততক্ষণে। কুরি কুরি বলে চিল্লাতে লাগলাম। যদিও জানি না মোরগ খেলে কি অসুবিধা। বৌ খুব খুশি  হয়ে যেতে যেতে বলল ‘মেইন দুয়ার’ বন্ধ করে দিতে। আমি আম্মার দিকে অবাক হয়ে চাইতেই আম্মা বললেন, ওটাও চাটগাঁইয়া ভাষা যার অর্থ প্রধান দরজা। আমি এবার বললাম, ওবুক (অয়াওও)। এমন নয় যে আম্মার দেশ চট্টগ্রাম, কিন্তু যে যেখানে কিছুকাল বাস করেছে সে সেখানের অনেক কিছু নিজের করে নেয়, রপ্ত হয়ে যায়। মানুষ রূপান্তরিত হতে থাকে সময় ও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে। গুগলে যেহেতু ঢুকেছি, তথ্য পেলাম, বাংলাদেশে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে। আবারো বললাম ‘অবুক’। শুধু তাই নয়, এটি পৃথিবীর ৮৮তম বৃহত্তম কথ্য ভাষা আর বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম ভাষা। বাংলাদেশের ৩য় বৃহত্তম ভাষা হচ্ছে সিলেটি ভাষা।

মনে পড়লো, প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন বলে প্রচলিত রয়েছে, ‘বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে’।  আবারো আনমনে বললাম ‘অবুক’। চট্টগ্রাম আসার পর থেকে যেন অবুক শব্দটির সাথে আমার দেখা মিলেছে, আর তাই বারবার যত্রতত্র যখন তখন অযথাই বলতে ইচ্ছে করেছে- অবুক, অবুক। অবাক আমি নিজেও। মনে মনে কি ভেবেছিলাম, এতে করে চারদিকে দ্রুত চিটাগোনিয়ান ভাবটা এসে যাবে। কে জানে! এককালের চেনা শব্দগুলো আরেক কালে অশুনা নাশুনা হয়ে আবার ধরা দিলে কেমন যেন লাগে। এর নামই কি নস্টালজিয়া!

আম্মা বলে যাচ্ছেন অনেকক্ষন থেকেই যে, আম্মার নাকি খুবই পিকনিক পিকনিক মনে হচ্ছে। আমার অবশ্য সে রকম কিছু মনে টনে হচ্ছে না। আমি বের হতে চাইছি দেখে আম্মার পিকনিকে কিছুটা ভাটা পড়েছে মনে হচ্ছে। আমাকে একা বের হতে দিতে আম্মার খুবই আপত্তি। আমি পথ ঘাট না চিনে দিকবিদিক জ্ঞানহারা হয়ে দিশেহারা অবস্থায় চট্টগ্রামের পথে পথে ঘুরতে থাকবো এটাই আম্মার ধারণা। ২২ বছর তো আর ২ দিনের ব্যাপার না। বহুত লম্বা চক্কর! তবে ভাবনাটা ঠিক না, তারপরও ভাবুক, মায়েদের কাজই  হচ্ছে প্রচুর ভাবনা চিন্তা করা, দরকারি বেদরকাির সব কিছু নিয়েই ভাবতে থাকেন তারা। থামানো যাবে না তাঁদের, সন্তান যে বয়সেরই হোক না কেন, তাঁরা ভাবনার একচ্ছত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমি আঙুলের করে (আঙুলের দাগ) বয়স গুনতে বসলাম, একহাত শেষ করে অন্য হাতও যখন শেষ করে, তৃতীয় বারের করেরও যখন হাতের আঙুলের মাঝামাঝির দিকে চলে যাচ্ছি অথচ তখনও ২০২২ ছোঁয়া যাচ্ছে না, তখন গোনাই বন্ধ করে দিলাম- ধুর! আম্মা যেমন বেখবর তার মেয়ের বয়স কত বেশি হয়ে গেছে তা নিয়ে, আমারও এ নিয়ে উদাসীন থাকা বেশ ভালো একটা পন্থা মনে হলো।  

আমাদের সেই বডিগার্ডকে খবর দেওয়া হয়েছে, সে লাপাত্তা। জাতি জানে না সে কোথায়। আমি মনে মনে চাইছিলাম না যে ওনার পাত্তা পাওয়া যাক। তবে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টার পর তাকে ফোনে পাওয়া গেলো, তারপর জানা গেল, ভোর বেলা সমুদ্র দেখবে বলে সে পতেঙ্গা চলে গেছে। আমরা সমুদ্র কোন দিকে তাই ভুলে গেছি কিন্তু উনি পৌঁছে গেছেন। ভালো কথা। কেউ একজন তো উপভোগ করছে চট্টগ্রামের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

আম্মা খুবই বিরক্ত, বলছেনও, মামার বাড়ির আবদার পেয়েছে সে, কাজে এসে বেড়াচ্ছে! মনে করিয়ে দিলাম আম্মাকে, আমরা না ডাকলে তার আসা নিষেধ। বলাই হয়েছে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে যেদিকে খুশি। উনিও এখন তাই পাখা মেলে উড়ছেন। তাহলে তো উনি আসলে আম্মার আজ্ঞাই পালন করছেন। আম্মা আমার যুক্তিতর্কে খুবই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়ে আজকাল এতো কথা বলে দেখে আম্মা খুবই বিরক্ত হন, আগে তো কথাই বলতো না, সব ওই আমেরিকাতে গিয়ে হয়েছে। আমি আরেকটু রাগিয়ে দিতে গিয়ে বললাম, তুমি চাইলেও এখন ওঁর  পাখা ছাটাই করতে পারবে না, কারণ সে তোমার থেকে উপরের দিকে তিন হাত বেশি লম্বা, তোমার এখন নানুকে জিজ্ঞেস করা দরকার কেন তোমাকে ওই বডিগার্ড থেকে বেটে বানিয়েছে। 

আম্মা দেখলাম হেসে দিলো। আমি যে চাইছিলাম না ওই লোককে নিয়ে, আমার একার কাছে, নিজের ফেলে আসা জায়গাগুলোতে যেতে, সেটা পূরণ হয়ে গেলো। সুদীর্ঘ ২২ বছর পর আমি এই শহরে এসেছি, আমি আমার মত কিছুটা সময়  ঘুরতে চাই এই শহরে। একটা রিকশা নিয়ে আমি একাই চললাম খাস্তগীর স্কুলের দিকে। আজকে আমি আপন মনে বেড়াবো। শুধু আমিই আমার সাথী। নিজস্ব এক নির্জনতায় নিজেকে ঘিরে আমি চললাম উঁকি মারতে খুবই সঙ্গোপনে আপন মনে বিহঙ্গময় এক সময়ের সঙ্গমে। রিকশাওয়ালা বললো ভাড়া ৫০ টাকা। ঢাকা থেকেই শুনে এসেছি রিকশাতে উঠলেই ১০ টাকা। চাকা ঘুরোনোর আগেই নেমে গেলেও ১০ টাকা। আমার জানা নেই খাস্তগীর স্কুলের ওই দূরত্বের দাম দর, আমার তা নিয়ে মাতামাতিও নেই । আমি উঠে বসলাম। আমার নিজেরই মনে হলো ঢাকায় বা চট্টগ্রামে আমি মনে হয় রিকশাওয়ালাদের খুব প্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি কারণ ‘ওতো না ততো’ বলে ওদের সময় নষ্ট করছি না। ভোটে দাঁড়ালে ওরা গণহারে আমাকে ভোট দিতো। আমাকে ওরা হয়তোবা বোকা ভাবছে কিন্তু আমি আসলে ওদের দিতে পেরেই যে খুশি হচ্ছি তা ওরা বুঝতেও পারছে না। রীতিমতো ছোটোখাটো দানবীর হয়ে উঠার চেষ্টা যেন। আসলে নিজের দেশের মানুষদের জন্য খুব লুকানো একটা প্রেম থাকে, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য। অকারণেই থাকে। আমারও যে আছে তা আমি নিজেই অনুভব করে খুশি হচ্ছি।

কাতালগঞ্জ থেকে জামালখানে অবস্থিত, আমার ছোটবেলার খাস্তগীর স্কুলে যেতে যেতে, চারধার আবারো দেখা যাবে ভেবে খুশি হয়ে উঠলাম। গতকাল হুরুস্থুলের মাঝে যা দেখেছি তা আজ আবারো আরো ভালো করে চেয়ে চেয়ে দেখা যাবে। অলিখাঁ মসজিদ হয়ে একটা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল রিকশাটা। হলটা মনে হয় বন্ধ হয়ে গেছে। কোন নাম লেখা নেই। আমিও আর মনে করতে পারলাম না ওই বেচারা হলটার নাম কি ছিল? ‘গুলজার’ ছিল কি নামটা? হঠাৎই এই নামটাই মনে এলো। বাম দিকে ছিল একটা দর্জি দোকান। নাই সেই সব আর কিছু। চারদিকে অনেক শপিং সেন্টার। আরো এগুলাম, কিছুটা এগুতেই দেখলাম আমার কলেজ। চট্টগ্রাম কলেজ। স্কুল থেকে ফেরার পথে নামবো। কাজেম আলী হাই স্কুলের পাশ দিয়ে চললাম আমার বিদ্যালয়ে। কিন্তু পৌঁছে দেখলাম স্কুল বন্ধ। গেইট লাগানো। দারোয়ান নেই। প্রবেশ করা গেল না। আমার থেকেও বেশি চেষ্টা করলো আমার রিকশাওয়ালা, এদিক ওদিক উঁকি দিতে লাগলো যেন কোনো ছিদ্র পেলে আমাকে ইঁদুর বানিয়ে ঢুকিয়ে দেবে। আমিও হয়তোবা একবারের জন্য হলেও ইঁদুর-বিড়াল হয়ে যেতে চাইতাম, খাস্তরীরে ঢুকবার জন্য। 

ভিকারুন্নেসা ছেড়ে আসার পর এই স্কুল থেকেই আমার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া। ঢোকা হলো না। একটু সামনে গেলেই ডানদিকে আমার বান্ধবী সোনালীর শ্বশুরবাড়ি। কত গেছি এক সময়। এখন ওখানে গেলেও হয়তোবা চেনা কাউকে পাবো না। চির চেনা হয়ে দরজা ধরে কেউ বসে থাকে না সবার জন্য অনেককাল। সবাই এগিয়ে যায় যার যার পথে। আমিও আমার পথে রওনা হলাম, এবার কলেজ। সেন্ট মেরিস স্কুলের সামনে দিয়ে রিকশাওয়ালা এগুলো। স্কুলের পাহাড়ের দেয়ালে অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা। লেখা দেখলাম ‘আজাদী’। আমার লেখক জীবনের সূচনার প্রথম লেখাটি এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, সেই এক কবেকার কথা যেন। আমি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রী তখন, আমাদের রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক মারা গেলেন, তাকে নিয়ে লেখাটি ছিল। সেদিনের সেই পত্রিকাতে নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখা ছিল এক অনন্য অনুভূতি। আমার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পর আজাদীর খালেদ আঙ্কেল আর জাফর আঙ্কেল আমাদের বাসায় এসেছিলেন আমার ইন্টারভিউ নিতে। সে ছিল বড় এক স্মরণীয় দিন। লজ্জা পেয়ে আমি লুকিয়ে গিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ দেব না। আজও দূরে থাকি লাইম লাইট থেকে, জন্ম থেকেই লাজুক আমি। একটু এগিয়ে ঠিক মিসকিনশাহ (রাঃ ) এর মাজারের সামনে দিয়ে মোড় নিতেই বললাম, চলেন তো গনি বেকারিতে যাই, বেলা বিস্কুট আছে কিনা দেখি। এক সময় খুব হেইট করতাম বেলা বিস্কুট। কলা আর বেলা ছিল আমাদের পুরা স্কুল জীবনের স্কুল থেকে দেওয়া বেশির ভাগ দিনের টিফিন। এখন সেই বেলা বিস্কুট মিস করি। একদিন যদি স্কুলে ওটা না দিয়ে অন্য কোনো টিফিন দিতো সেদিন যে কি আনন্দ হতো আমাদের। 

নামলাম গনি বেকারির সামনে। বেকারিতে প্রচুর ভিড়। এটা ওটার দাম জিজ্ঞেস করলাম। সিঙ্গারা ১০, সমুচা ১৫, আরো কি কি বললো এটা ওটা। যে বলছে সে খুব বিরক্ত হচ্ছে। কেউ এত কথা জিজ্ঞেস করে না, তুলে নেয় আর দাম দেয়। আমাকে দেখে যদিওবা তার যদি কোনো কারণে ধারণা হয়ে থাকে যে আমিও পয়সাওয়ালাদের একজন, সেই ধারণা এতো দাম জিজ্ঞাসার কারণে যে ভঙ্গ হয়ে খান খান হয়ে গেছে, তা আমি তার পরের উত্তরেই বুঝলাম। কিমা পরোটা দেখে আমি জানতে চাইলাম এটার দাম কত? সে সাথে সাথে বেশ উঁচু স্বরে উত্তরটা দিলো এমনভাবে যে, এটা নেওয়া যেমন তেমন কথা নয়, কারণ একটাই ৫০ টাকা। 

আমার অবশ্যই একটু হাসি পেলো। আমি বললাম, আমার বান্ধবী সোনালী চাইলে একাই আপনার সব কিমা পরোটা কিনে নিয়ে ফেলেও দিতে পারে। সে খুবই ভ্যাবাচেকা খেয়ে চেয়ে আছে দেখে বললাম, খেয়েও ফেলতে পারে। ছেলেটির মুখে শান্তি ফিরে এলো। তার মালিকের জিনিস ফেলে দিলে তার যেন বুক ফেটে যাবে! মালিকের ছেলে নয়তো এ! নাহ তা হবে না। বাংলাদেশের বড়োলোকের ছেলেরা এই ধরনের কাজ করে না যা আমেরিকাতে হরহামেশাই করে। গলির ধরে যে মম এন্ড পপ শপ থাকে হাসি মুখে ছেলেমেয়েরা তাদের সময় দেয়, শ্রমও, অবশ্যই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থের বিনিময়ে। আমাদের দেশে এখনো ঘরোয়া সাহায্য অর্থ মূল্যে পরিমাপ করা হয় না, এখনো সেটি আন্তরিকতা আর পারিবারিক অধিকারের আওতায় রয়েছে। সব কিছুতেই বাণিজ্য কাঙ্খিতও নয়। কাজ নেই তো খই  ভাজ পলিসিতে জানতে চাইলাম, আপনি কি মালিকের ছেলে? ছেলেটি এবার তাজ্জব হয়ে চেয়ে থাকলো। সে কি বলবে তাই যেন খুঁজে পাচ্ছে না। আমাকে পৃথিবীর চূড়ান্ত নির্বোধ ভেবে কেবল হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো। পাশ থেকে আরেকজন খুবই যেন মজা পেয়ে বললো, একে দেখে কি আপনার সেই রকম মনে হচ্ছে! বলে আবার মুখ টিপে হাসছে। সহকর্মীর এতো প্রমোশন মনে হয় সহ্য হচ্ছিলো না তার। আমি বললাম, আপনাকে মনে হচ্ছে, আপনি এবার খুশি হন। সেও এবার তটস্থ হয়ে গেলো। তার আধ ময়লা শার্ট টেনে টুনে ঠিক করতে ব্যস্ত হলো।

আমি অযথাই পথে পথে পাওয়া আমার শহরের বাসিন্দাদের সাথে খোশ গল্প করতে চাইলাম, অপ্রয়োজনীয় বাত-চিত। ছিটগ্রস্ত মানুষ ভাবলো কিনা, কেউ পাত্তাই দিলো কিনা, কারও ভালো লাগলো কিনা বা কি ভাবলো কিছুই না ভেবে আমি যেন সেই ছোট বলার মতন এক্কা দোক্কা খেলার মতন করে চট্টগ্রামের মাটিতে গুটি ফেলে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলাম। হ্যালো মাই ডিয়ার শহর, আমি এসেছি, তুমি কি তা দেখতে পাচ্ছ? বলেছিও আনমনে তা কয়েকবার।

দোকানি দুইজনের একজন হাঁ করে, আরেকজন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকলো। তারপর অন্য খরিদ্দারদের দিকে চাইতে লাগলো, এতো আজাইররা সময় কার আছে আমার বকবক শোনার জন্য! ব্যস্ত পৃথিবী, ব্যাতিব্যস্ত লোকালয়। বললাম কিমা পরোটা ২টা দিন, আমার জন্য একটা আর আমার রিকশাওয়ালার জন্য একটা, সাথে দুইটা ড্রিঙ্কসও দিন। এবার ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে  জানতে চাইলো, রিকশাওয়ালার জন্য নেবেন? এতে তার কি সমস্যা! বুঝলাম না। বললাম, আপনি খেতে চাইলে আপনার জন্যও একটা নিয়ে রাখতে পারেন। আমি ভেবেছিলাম সে হয়তোবা বলবে, ময়রা মিষ্টি খায় না, বা সেরকম কিছু। কিন্তু এবার সে কোনো কথা না বলে আমাকে দুটো প্যাকেট ধরিয়ে দিলো শুধু।

রিকশাওয়ালা তো প্যাকেট পেয়ে বেশ খুশি। যদিওবা সে হা হা করে হাসছে না কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় খুব বিগলিত, নীরবে সে আনন্দিত। তার পরবর্তী কিছু কথায় আর কাজে আমি বুঝলাম সে খুশি হয়েছে। তাকে বললাম, এবার আসলে ওই উপরের দিকে পাহাড়ের দিকে উঠবো। রহমতগঞ্জ যাবো। ঐ দিকের পাহাড়ের ঢালুতে যাবো। উঠতে পারবেন? পারবো বলে সাথে সাথে টান দিল। বলল, এ দেশের মানুষের মনে কোনো মায়া দয়া নাই, বাইরের থেকে আসে যারা তাদের মন অনেক বড়ো। ভাবলাম, এটা কিসের প্রতিক্রিয়া, কিমা পরোটার না পাহাড় বাইতে পারব কিনা জিজ্ঞেস করার। যাই হোক, সে তার ঠোঙাটা ঝুলিয়ে রেখেছে হাতলে। আমি মজা করে খাচ্ছি আর খুশি হচ্ছি, আমার কারণে দেশের মানুষ তার কাছে বকা খাচ্ছে তাই দেখে খুশি হচ্ছি। দেশেও থাকবে বকাও খাবে না, তা তো ঠিক হলো না। তারপরেই মনে এলো, এ জানলো কিভাবে আমি প্রবাসী। আমি তো বলিনি। এদের আইকিউ খুব হাই। আমি দেখেছি একই বয়সী বাংলাদেশি বাচ্চার যে চিকনা-চাকনি অলিগলি মারা বুদ্ধি আমেরিকান বাচ্চাদের তা নেই বা খুবই কম। বাস্তবতা অনেক কিছু আপন মনেই শিখিয়ে দেয়। ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করবো না, তারপরও করেই ফেললাম, কেমনে বুজলেন আমি এই দেশে থাকি না? উনি হাসলেন। বললেন, বুঝলাম। আমি আবারো জানতে চাইলাম। বললো এবার তার পর্যবেক্ষণের ধাপগুলো। আমি তাকে আপনি আপনি বলছি, তুমি তুই না। আমি ভাড়া নিয়ে কোনো বিতর্ক করিনি। এবং আমি জানিই না শনিবার স্কুল বন্ধ থাকে। আরো বললো, আমি মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিলাম একবার ঢুকতে স্কুলে, সেই ছোট বেলায়। আমি এই দেশে থাকলে আশপাশে দিয়ে কত যাওয়া হতো, এক সময় ফিরে দেখার কথাও মনে থাকতো না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আরো বলল, ভালো হয়েছে যে আমি ঢুকিনি, অন্যরকম দেখলে আমার মন খারাপ হতো। এই মহাজ্ঞানী শুকনা পাতলা মনোবিজ্ঞানী হয়তো এটাও বুঝে নিচ্ছে যে এবার আমার কান্না পাচ্ছে। সে কোনো কথা আর বলছে না। টেনে তুলছে রিকশাটা। রহমতগঞ্জের এই পাহাড়টার নাম যেন কি ছিল?

মনে করতে পারলাম না। তারপর হঠাৎই মনের পড়লো ‘গুডস হিল’। মনের ভিতর অলিতে গলিতে নামগুলো ছিল লুকিয়ে চুরিয়ে। পাহাড়ের ঢালুতে একটি বিশাল পেট্রোল পাম্প ছিল বেকারিটির ঠিক সামনের রাস্তার ওই পাশে, আমাদের খুব ছোট বেলাতেই সেটি তৈরী হয়েছিল, আজও আছে কি সেটা ! আশ্চর্য একবার খেয়ালও করিনি, চোখে না পরার কথা নয়, অলরেডি দুইবার গিয়েছি এই পথে তারপরও আত্মভোলা হয়ে ছিলাম, দেখেছি কি দেখিনি তাই মনে করতে পারছি না। দেখবার জন্য রিকশার পিছনের হুড তুলে দেখবার চেষ্টার করলাম, পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে ততক্ষণে, দেখতে পেলাম না আর। এই পথেই ফিরতে হবে, তৃতীয়বারে দেখে নেবো।

আমার নানার বাড়ি যাচ্ছি। এখন আছি একদম চূড়ায়, নিচের দিকে নামতে গেলেই এই পাহাড়ের ঢালুতে সেটি রয়েছে। আমি বহু আগে থেকেই জানি যে আমার নানার বাড়িটা এখন আর আমাদের নেই। সব বিক্রি করা হয়ে গেছে। আমি তারপরও গেলাম। চললাম, আবদুস সাত্তার রোড। আমার আজন্ম চেনা সেই বাংলো বাড়িটিতে। নানার বাড়ি, মধুর হাড়ি। ‘গুডস হিল’ পাহাড়টির পাশ কেটে এগিয়ে গিয়ে রিকশা পাহাড় বেয়ে নামতে লাগলো। রিকশাওয়ালাকে বললাম, ডানদিকে ছোট একটা গলি আছে, সেই গলির মাথায় আমার নানার বাড়ি ছিল, গলিটা মিস করবেন না যেন। রিকশাওয়ালা এমনভাবে মাথা দুলিয়ে ঘাড় বাকালো যেন কোনো ভাবেই হারিয়ে ফেলার খেলায় তাকে হারানো যাবে না। আমি নিশ্চিত হলাম। খুশি মনে পেকেট খুলে খেতে লাগলাম। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে সবাই যে দেখছে এই খাওয়ার দৃশ্য সেটা আমি খুব একটা পাত্তাতেই আনলাম না। ওনারা দেখছেন বলে যে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী আমার পেটে ব্যথা হওয়ার আশঙ্কাকেও তোয়াক্কা করলাম না। খুবই ড্যাশিং অবস্থা আমার। ওরা আমার দেশের মানুষ ওদের নজরে আমার অসুবিধা হবে না, এরকম প্রত্যয়ে বলীয়ান যেন আমি। ওরা হয়তো শুনলে বলবে, ওরে আমার কে রে? একবারের ঘোরাঘুরিতেই গলি পেলাম, কেবল পৌঁছে দেখলাম কোথাও কিছু নেই। ওই একই ঘটনা, সব বদলে গেছে। আমার নানার বাড়িটির চারদিকের খোলা জায়গাসহ খুব সম্ভবত ২০ কাঠার মতন জায়গাজুড়ে ছিল। পুরাটাজুড়ে এখন এপার্টমেন্ট। বহুতল  ভবন। যেন কেউ সাইকেলে চড়ে আসতে আসতে জোরে গিয়ে ধাক্কা খেলো নাক বরাবর দেয়ালে। সামনেই দেয়াল। আমি খুঁজে পেলাম না নানার বাড়ি।

মাঠ ঘাট পথ সব হারিয়ে গেছে সময়ের এক গহ্বরে। জানতাম আগেই তারপরেও যেন দেখতে হলো মেনে নিতে। অনেক দিন পর ‘কোথাও কেউ নেই’ কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগলো। কোথায় যেন যাওয়ার ছিল— এরকমের একটা ভাব  ঘুরতে লাগলো মনের ভিতর।

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়