ঢাকা     শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৭ ১৪৩১

বছরের শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কদর

প্রকাশিত: ১২:০১, ৬ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ১২:০৩, ৬ এপ্রিল ২০২৪
বছরের শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কদর

নিশ্চয়ই আমি কদরের রজনীতে কোরআন নাযিল করেছি। কদরের রজনী সম্বন্ধে আপনি জানেন কি? কদরের রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। (সূরা কদর, আয়াত:১-৩) 

এভাবেই মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে এ রাতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। দয়াময় প্রভুর অগণন নেয়ামতের মধ্যে অন্যতম একটি নেয়ামত হলো সময়। যাকে তিনি (দিন-রাত) দুইভাগে বিভক্ত করেছেন এবং কিছু সময়কে কিছু সময়ের উপর প্রাধান্য দান করেছেন। যেমন সপ্তাহের মধ্যে জুমার দিন, মাসের মধ্যে রমজান মাস ইত্যাদি। তেমনিভাবে দয়াময় আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের হেদায়াতপ্রাপ্তি, গুনাহ মোচন ও দোয়া কবুলের জন্য রাতসমূহের মধ্যে লাইলাতুল কদরকে সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন এবং এ রাতের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে স্বতন্ত্র একটি সূরা নাযিল করে এ রজনীকে করেছেন আরো মহিমান্বিত, মর্যাদাবান ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

‘লাইলাতুল’ শব্দের অর্থ রাত বা রজনী। আর ‘কদর’ শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা ও পরিমাণ ইত্যাদি। সুতরাং লাইলাতুল কদর অর্থ শ্রেষ্ঠ রজনী, মর্যাদাবান রাত্রি। হযরত আবু বকর ওয়াররাক (রহ.) এ রাতের নামকরণ সম্পর্কে বলেন, গুনাহের জালে জড়িয়ে পড়ার কারণে যে ব্যক্তি ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও মর্যাদাহীন; এমন অপরাধীও যদি এ রাতে ইবাদত-বন্দেগী, তাসবিহ- তাহলীল, দোয়া-যিকিরে মশগুল হয়, খাস দিলে তাওবা করে এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে মহান স্রষ্টার দরবারে গুনাহ মাফের ফরিয়াদ করে, তখন সেও হয়ে যায় মহান আল্লাহ তা’আলার নিকট বিশেষ মর্যাদাবান।

আরো পড়ুন:

প্রিয় পাঠক! মহান রাব্বুল আলামিন এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন, কদরের রজনী হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। (সূরা কদর, আয়াত:৩) এখানে মহান আল্লাহ তা’আলা লাইলাতুল কদর বা শবে কদরকে হাজার মাসের সমান বলেননি; বরং হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলেছেন। তাই আমরা যদি কদরের রজনীকে এক হাজার মাসের সমানও ধরি, তাহলে এ রাতটি তিরাশি বছর চার মাসের সমপরিমাণ হয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেল এবং তাতে ইবাদত-বন্দেগী করলো, সে যেন তিরাশি বছর চার মাস ইবাদত করার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করলো। তারপরও এ রাত হাজার মাস অপেক্ষা কত গুণ উত্তম? একগুণ, দ্বিগুণ না বহুগুণ, তা প্রজ্ঞাময় প্রভু ভালো জানেন।

মহান আল্লাহ তা’আলা এ সূরার মাঝে লাইলাতুল কদর বা শবে কদরের চারটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন:
১. এ রজনীতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে
২. এ রাতে জিবরাইল (আ.) এর নেতৃত্বে ফেরেশতারা দুনিয়াতে আগমন করেন
৩. এ রাতটি হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম
৪. এ রাতে সুবহে সাদিক পর্যন্ত শান্তি ও নিরাপত্তার বারি বর্ষিত হতে থাকে 

হযরত মুজাহিদ (রহ.) এই সূরা কদরের শানে নুজুল প্রসঙ্গে বলেন, প্রিয়নবী (সা.) একবার বনী ইসরাঈলের এক ব্যক্তির আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন, তিনি এক হাজার মাস পর্যন্ত আল্লাহর পথে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সাহাবীরা এ কথা শুনে যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত হলেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা সূরা কদরের প্রথম আয়াত থেকে তৃতীয় আয়াত পর্যন্ত নাযিল করলেন এবং এই আয়াতে কদরের এক রজনীর ইবাদতকে উল্লেখিত মুজাহিদের হাজার রাতের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম সাব্যস্ত করলেন। (বায়হাকী)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের নিয়তে ইবাদতের জন্য দণ্ডায়মান হয়, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (বুখারী, মুসলিম)

হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) তাঁর এক আলোচনায় বলেন, পারস্যবাসীদের নেতা হলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.)। রোমীয়দের নেতা হলেন হযরত সুহাইব রুমী (রা.)। আবিসিনিয়াবাসীর সরদার হলেন হযরত বেলাল (রা.)। সকল জনপদের সেরা হলো মক্কা মুর্কারামা। সকল উপত্যকার সেরা হল বাইতুল মুকাদ্দাস উপত্যকা। সকল রজনীর শ্রেষ্ঠ হল লাইলাতুল কদর, বা কদরের রজনী। সকল গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল-কোরআন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন জুমার দিন। সকল পাথরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পাথর হাজরে আসওয়াদ। 

সকল কূপের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কূপ হলো যমযম। সকল লাঠির সেরা হল হযরত মুসা (আ.) এর লাঠি। সকল মাছের শ্রেষ্ঠ হলো যে মাছের পেটে হযরত ইউনুস (আ.) অবস্থান করেছিলেন। সকল উটের মধ্যে উত্তম হলো হযরত সালেহ (আ.) এর উট। সকল বাহনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো বোরাক। সকল আংটির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো হযরত সুলাইমান (আ.) এর আংটি এবং সকল মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস হলো রমজান মাস। (আল গুনিয়াতু লি তালিবে তারীকিল হক)

উল্লেখ্য যে, মহান মনীষীর এ মূল্যবান বাণী দ্বারাও লাইলাতুল কদরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতীয়মান হয়।

শবে কদর কোন রজনীতে হবে?

লাইলাতুল কদর বা শবে কদর কোন রজনীতে হবে প্রজ্ঞাময় স্রষ্টা বিশেষ কারণে তা গোপন রেখেছেন এবং মহানবীও (সা.) এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বর্ণনা করেননি। তবে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা মাহে রমজানের শেষ দশকের যে কোনো বেজোড় রজনীতে লাইলাতুল কদরকে অন্বেষণ কর। (বুখারী, মুসনাদে আহমদ)

অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে, মাহে রমজানের ২৭ শে রজনী হলো শবে কদর হওয়ার অধিক সম্ভাবনাময় রাত। এ মতের পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো- আরবী ভাষায় লাইলাতুল কদর বাক্যটিতে মোট নয়টি হরফ আছে এবং এই বাক্যটি সূরা কদরে তিনবার এসেছে। সুতরাং নয়কে তিন দ্বারা গুণ করলে সাতাশ হয়। এর দ্বারাও একটি সম্ভাবনা জাগরিত হয় যে, শবে কদর রমজানের সাতাশতম রজনীতে হতে পারে। তবে যে ব্যক্তি শবে কদরের পুরস্কার নিশ্চিতভাবে অর্জন করতে চায়, তার জন্য মাহে রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি বেজোড় রজনীতে জাগ্রত থেকে মহান প্রভুর ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়।

প্রিয় পাঠক! খুব গভীরভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, কোনোক্রমেই যাতে লাইলাতুল কদর থেকে আমরা মাহরুম বা বঞ্চিত না হই। কারণ রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের মাঝে একটি মাস এসেছে যার মধ্যে এমন এক রজনী রয়েছে যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি উক্ত রজনী হতে বঞ্চিত হলো, সে যেন যাবতীয় কল্যাণ হতে বঞ্চিত হলো। (ইবনে মাযাহ্)

হে বিশ্বাসী ভাই ও বোনেরা! এ রজনী হতে পারে আমাদের জীবনের শেষ শবে কদর। তাই আসুন, এ রাতে অতীতের কৃত অপরাধের জন্য আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হই। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি মহান প্রভুর দরবারে। ঢেলে দিই হৃদয়ের সবটুকু আকুতি। তওবার মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন করি গুনাহের গন্ধে কলুষিত অন্তর-আত্মা। আল্লাহ তা’আলা আমাদের শবে কদরের পুরস্কার অর্জনের তাওফিক দান করুন।  

  

শাহেদ//

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়