রমার স্মৃতি বিজড়িত সুচিত্রা সেন সংগ্রহশালা
বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। অভিনয়, ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যে বাঙালিকে প্রায় তিন দশক ধরে মাত করে রেখেছিলেন। ১৯৫২ সালে 'শেষ কোথায়' ছবির মধ্যে দিয়ে সিনেমা যাত্রা শুরু হয় সুচিত্রা সেনের। দীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয় করার পরে ১৯৭৮ সালে হঠাৎই অবসর নেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে মহানায়িকা অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে সাত পাকে বাঁধা ছবির জন্য ৩য় মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। ভারতে ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হন সুচিত্রা সেন। তবে সেই সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ সেই সম্মাননা গ্রহণ করতে হলে তাকে জনসম্মুখে আসতে হতো। এতে রাজি ছিলেন না মহানায়িকা। জানা যায়, অভিনয় ক্যারিয়ার শেষে সুচিত্রা সেন নিজেকে রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন ।
সুচিত্রা সেন মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে যেসব সিনেমায় অভিনয় করেছেন সেগুলো আজও সিনেমাপ্রেমীদের অভিভূত করে। সাড়ে চুয়াত্তর, মরণের পরে, অগ্নিপরীক্ষা, দেবদাস, সাগরিকা, হারানো সুর, পথে হল দেরি, দ্বীপ জ্বেলে যাই, সপ্তপদী- এখনও যেন চিরসবুজ। আমার বিশ্বাস এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাও সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমা দেখলে মোহগ্রস্ত হয় এবং পরবর্তীতেও হবে। বাংলা সিনেমার এই মহানায়িকা শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের নন, বাংলাদেশেরও অমূল্য সম্পদ। এই দেশই তার জন্মভূমি।
জানা যায়, ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল তৎকালীন বৃহত্তর পাবনা জেলার বেলকুচি উপজেলার ভাঙাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন রমা দাসগুপ্ত। তার বাবা বাবা করুণাময় গুপ্তের বাড়ি ছিলো গোপালপুরে। অর্থাৎ গোপালপুরই সুচিত্রা সেনের আদি নিবাস। ছোট্ট রমা এই আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছেন, কিশোরীবেলাতেও এখানেই ছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কয়েক মাস পরেই তার পরিবার কলকাতায় চলে যায়। সেই থেকে রমা দাসগুপ্তের স্মৃতি ছাড়া এই বাড়িটি কোনদিন তার ছায়াও পায়নি।
সুচিত্রা সেন আমার প্রিয় নায়িকা। তাকে সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু পাবনা শহরে এসে তার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটাও দেখে যাবো না, এমনটা হতে পারে না। পাবনা শহরের গোপালপুরে হেমসাগর লেনে দাঁড়িয়ে আছে সুচিত্রা সেনের বাড়ি। বিস্তৃত আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে মনে হলো, এই আঙিনায় লেগে আছে মহানায়িকার পায়ের ছাপ। বাড়িটির দেয়ালগুলোতে লেগে আছে তার হাসি, কান্নার অদৃশ্য প্রলেপ।
বাড়িটিতে সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে সুচিত্রা সেন সংগ্রহশালা। এর দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে পাবনা জেলা প্রশাসন। ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল থেকে দর্শনার্থীরা এই বাড়িটি দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে ১০ টাকার টিকিট কাটতে হয়। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে সবাই এসে ঘুরে যেতে পারবেন এখানে।
ভেতরে গেলে শুনতে পাবেন সুচিত্রা সেনের অভিনীত সিনেমার গান। যা অন্যরকম একটা আবহ তৈরি করে। এরপর ঘরের ভেতরে রয়েছে ‘রমা থেকে সুচিত্রা সেন’ নামের গ্যালারি। সেখানে গেলে চোখে পড়বে নানা রকম স্থিরচিত্র। তবে সুচিত্রা সেনের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের খুব একটা দেখা মেলে না। দেশ বিভাগের পর পর সুচিত্রা সেনের পরিবার যখন কলকাতায় চলে যায়, এরপর বাড়িটি দখল হয়ে যায়। কিছু না হোক, এই বাড়ির দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা সুচিত্রা সেনের অভিনীত সিনেমার পোস্টার, সিনেমার দৃশ্য, ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ছবি আপনাকে অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি দেবে। তা ছাড়া, দেয়ালের ফেস্টুনে লেখা আছে, সুচিত্রা সেনের ভালো লাগা, না লাগা বিষয়ে নানা তথ্য। বাড়িটি ঘুরে দেখে নিজের মতামত লেখার সুযোগ রয়েছে। দর্শনার্থীরা ‘পরিদর্শন বহি’তে নিজেদের অনুভূতির কথা লিখে আসতে পারেন। বিশেষভাবে ভালো লাগবে সুচিত্রা সেনের অবক্ষ ভাস্কর্য। মহানায়িকার হাসিটা ওই ভাস্কর্যে অমলিন!
আমার কেবলই মনে হয়েছে, এই সংগ্রহশালা আরও সমৃদ্ধ হতে পারতো! এখানে যদি সুচিত্রা সেনের স্মৃতিবিজড়িত জিনিস, পত্রের সন্নিবেশ ঘটানো যায় তাহলে খুব ভালো হয়। সংশ্লিষ্টদের প্রতি আবেদন, সংগ্রহশালাটাকে সত্যিকার অর্থে সমৃদ্ধ করে তুলুন।
উল্লেখ্য, সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক এই বাড়িটি দখল হয়ে গিয়েছিল। এই বাড়িতে ‘ইমাম গাযযালী ইনস্টিটিউট’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ২০১১ সালে হাইকোর্ট দখলকারী প্রতিষ্ঠানকে বাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপরে ওই বাড়িটিতে সুচিত্রা সেনের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করার জন্যও আদালত নির্দেশ দেয় আদালত।
সম্প্রতি পালিত হলো মহানায়িকার ৯৩তম জন্মবার্ষিকী। এমন জন্মদিন ফিরে ফিরে আসবে কিন্তু সুচিত্রা সেন আর ফিরে আসবেন না। পাবনায় তবু তার নাম বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকবে সুচিত্রা সেন সংগ্রহশালা। যারা পাবনায় আসবেন, তারা একবার ঘুরে যেতে পারেন এই বাড়ি থেকে।
আরও পড়ুন: জাহ্নবী চৌধূরাণীর সন্তোষ ভাসানীর গল্প বলে
/লিপি