ঢাকা     সোমবার   ০১ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৭ ১৪৩১

রাসেলস ভাইপার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যত গুজব

হৃদয় তালুকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১২, ২২ জুন ২০২৪   আপডেট: ১৫:২৮, ২২ জুন ২০২৪
রাসেলস ভাইপার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যত গুজব

ছবি: সংগৃহীত

রাসেলস ভাইপার নামের সাপ নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই সাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে নানা গুজব। কেউ বলছে রাসেলস ভাইপার কামড়ালে অ্যান্টিভেনম নেই, কেউ বলছে চিকিৎসা নেই। অনেকের দাবি রাসেলস ভাইপারই সবচেয়ে বিষাক্ত ও হিংস্র সাপ। গবেষকরা বলছেন অন্য কথা।

রাইজিংবিডির সাথে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ভেনম রিসার্চ সেন্টারের সমন্বয়ক ও গবেষক ড. আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ। তিনি বলেন, রাসেলস ভাইপার সাপ কামড়ালে কোন চিকিৎসা নেই, রাসেলস ভাইপার কামড় দিলে নির্ঘাত মৃত্যু; আসলে ব্যাপারগুলো এমন নয়। 

এই গবেষক জানান, বাংলাদেশে সাপ নিয়ে যে গবেষণাগুলো হয়েছে সেগুলোতে উল্লেখ আছে রাসেলস ভাইপার নামের সাপ বাংলাদেশে আছে। প্রাচীনকাল থেকে এ সাপ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রয়েছে। মাঝখানে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়েছিলো। গবেষকরা বেশ কিছু বছর রাসেলস ভাইপারের সন্ধান করেও পায়নি। ২০১২ সালের রাজশাহীর তানোরে যখন প্রথম রাসেল ভাইপার একজন কৃষককে কামড় দিলো এবং মারা গেলো তখন আবার এই সাপের অস্তিত্ব সামনে এলো। রাসেলস ভাইপার সাপের রং প্রকৃতির সঙ্গে মিলে যায়। এই সাপ কোন হিংস্র সাপ নয় খুবই অলস প্রকৃতির সাপ। এক জায়গায় কুন্ডলী পাকিয়ে এরা বসে থাকে। এরা বাইরে বের হয় খাবারের সন্ধানে।

ড. আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, বাংলাদেশে সাপের আবাসস্থলগুলো আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। জঙ্গল কেটে বিল্ডিং তৈরি করেছি, আবাসস্থল নষ্ট হওয়ার কারণে এই সাপ লোকালয়ে চলে এসেছে। রাসেলস ভাইপার পানিতে দ্রুত অগ্রসর হতে পারে। রাজশাহীর পদ্মা দিয়ে যেভাবে এসেছে এভাবে যমুনাসহ নানা নদী দিয়ে ২৭ জেলায় ছড়িয়ে গিয়েছে। এই সাপ পানি বা নদীর অববাহিকা দিয়ে সারাদেশে ছড়াচ্ছে। আমরা গবেষণা করে একটা ম্যাপ তৈরি করেছি। যে  যে এলাকায় রাসেলস ভাইপার কাউকে কামড়েছে এবং যে যে এলাকায় লোকেরা রাসেলস ভাইপার সাপ মেরেছে সেগুলো ধরে আমরা ম্যাপিং করেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব ম্যাপ ছড়িয়ে পড়েছে এগুলো ভুল।


এই গবেষক আরো বলেন, রাসেলস ভাইপার ছড়াচ্ছে কারণ এই সাপ দ্রুত বংশবিস্তার করে। অন্যান্য সাপ যেমন আগে ডিম পারে এরপরে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় কিন্তু রাসেলস ভাইপার সরাসরি বাচ্চা জন্ম দেয়। একসঙ্গে ২৫-৩০টি বাচ্চা দিয়ে থাকে। আমি আসলে এসব বেশি জায়গায় বলতেও চাইনা, আমাদের ভেনম রিসোর্স সেন্টারে ৫০টির বেশি অ্যাডাল্ট রাসেলস ভাইপার আছে। আমাদের বাংলাদেশের অনেক জায়গা থেকে রাসেলস ভাইপারের ভেনম সংগ্রহ করেছি এবং নানা ধরনের গবেষণা চলছে।

মানুষ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে যেখানে এই সাপ দেখা যাবে যেন মেরে ফেলা হয়। এ বিষয়ে ড. আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, অজগর এবং রাসেলস ভাইপার দেখতে প্রায় একই রকম। মানুষ রাসেলস ভাইপার না পেয়ে অজগর সাপও মেরে ফেলছে। নিরীহ একটা পাইথন সাপকেউ পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। ফেসবুকে এমন অনেক ভিডিও ছড়িয়ে। অজগর সাপ একটি নির্বিষ সাপ, অজগর সাপের কোন বিষ থাকে না। তবে এই সাপ মানুষকে পেঁচিয়ে ধরে খেয়ে ফেলতে পারে। আল্লাহ যেসব পশু-প্রাণী সৃষ্টি করেছেন সবই তো প্রকৃতির কোনো না কোনো উপকার করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সাপতো আমাদের অনেক ধরনের উপকারও করছে। গ্রামে গঞ্জে নানা ধরনের পোকামাকড়, ব্যাঙ, ইঁদুর; এসব খেয়ে নিচ্ছে নাহলে এসবের পরিমাণ অনেক বেড়ে যেতো। মানুষ যেকোন ধরনের সাপ দেখলেই পিটিয়ে মেরে ফেলছে রাসেলস ভাইপার ভেবে।  কারণ তাদের ভেতরে এই গুজবটা ছড়ানো হচ্ছে যে রাসেল ভাইপার কামড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মারা যাবে। অনেকেই বলছে রাসেল ভাইবার পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ, বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ এসব আসলে সঠিক নয় এর চেয়েও বিষাক্ত সাপ বাংলাদেশ আছে।

রাসেলস ভাইপারের কামড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে রোগীর মৃত্যু হয় এই গুজবের বিষয়ে তিনি বলেন, রাসেলস ভাইপার কামড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হওয়ার কোন সুযোগই নেই। আমাদের দেশে গ্রামে গঞ্জে এই সাপের কামড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণই হচ্ছে মানুষ চলে যায় ওঝাঁর কাছে। অপচিকিৎসা,সময় ক্ষেপণ এবং হাসপাতালে আসতে দেরি করার কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা মিনিমাইজ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাসেলস ভাইপার বা যেকোন সাপ কামড় দিলেই সরাসরি হাসপাতালে যেতে হবে হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম আছে এবং চিকিৎসা রয়েছে। সরকার বিনামূল্যে ভেনম দিচ্ছে এবং এতে করে চিকিৎসা নিয়ে শতকরা ৯০% রোগী সুস্থ হওয়া সম্ভব।

তিনি জানান বাংলাদেশ যে অ্যান্টিভেনমগুলো আছে সেগুলো ইন্ডিয়ান স্নেকের বিরুদ্ধে তৈরি। এখানে ৪টি সাপের বিরুদ্ধে এসব অ্যান্টিভেনম কাজ করে। এগুলোর একটি হচ্ছে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম। যা রাসেলস ভাইপার কামড়ালে প্রয়োগ করা হয়। রাসেলস ভাইপার কামড়ালে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং এটি কার্যকর। হয়তো অনেক সময় ডোজ বেশি লাগে কখনো কখনো রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।

ড. আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, রোগীকে শুধু অ্যান্টিভেনম দিলেই হবে না আরও কয়েকটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। যেমন— রোগী মূর্ছা যেতে পারে, কিডনির সমস্যা হতে পারে, লাল প্রসাব হতে পারে, রক্তবমি হতে পারে, পায়খানা দিয়ে রক্ত যেতে পারে। এসবের আলাদা চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। এইজন্যই সাপে কাটলে প্রথমে হাসপাতালে যেতে হবে এবং চিকিৎসা নিতে হবে।

মানুষকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এই গবেষক বলেন, ধরা যাক কৃষক ধান কাটতে যাচ্ছেন এবং তিনি জানেন যে ক্ষেতে সাপ থাকার সম্ভাবনা আছে তাহলে পায়ে গামবুট পারে যাবেন। রাতে ঘর থেকে বের হলে হাতে একটা টর্চলাইট নিয়ে বের হবেন। জঙ্গলে গেলে হাতে একটি লাঠি নিয়ে বের হবেন। বাড়ি দিতে দিতে এগিয়ে গেলে শব্দ পেয়ে সাপ পালাবে। রাসেলস ভাইপার সাপ মানুষ দেখলেই তেড়ে আসে এটা একেবারেই মিথ্যা কথা। সাপের ন্যাচারই এটা না। বাংলাদেশে বিদ্যমান যেসব সাপ আছে সেসব কোন সাপই কাউকে তেড়ে এসে কামড় দেয় না। সাপ মানুষকে কামড় দেয় আত্মরক্ষার জন্য। যখন সাপ মনে করে তাকে কেউ আক্রমণ করছে তখনই সে কামড় দেয়।সাপে কামড় দেওয়ার ঘটনাগুলো এররকম যে, কেউ ধান কাটতে গিয়েছিল এবং সাপের পায়ে পাড়া লেগেছে এরপর সাপ তার পায়ে কামড় দিয়েছে। অথবা সাপ ধানের ক্ষেতে শুয়েছিল কাঁচি দিয়ে সেই সাপকে মারতে গিয়েছে তখন সাপ কামড় দিয়েছে। কোন সাপই মানুষকে তেড়ে এসে কামড় দেয় না। রাসেলস ভাইপারও না।  এটি অত্যন্ত নিরীহ এবং অলস সাপ কিন্তু বিষধর। একেকটা কামড়ে প্রচুর পরিমাণ বিষ দিতে পারে৷ ওদের ভেনম প্রোডাকশন বেশি। এজন্য রাসেলস ভাইপের কামড় দিলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা নিতে হবে। রাসেলস ভাইপার কামড় দিলে একাধিক অ্যান্টিভেনম লাগতে পারে।

তিনি আরো বলেন, দেশের যেসব অঞ্চলে রাসেলস ভাইপার রয়েছে সেসব অঞ্চলে সরকারি উদ্যোগে অ্যান্টিভেনম পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। 

সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচতে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, সাপ তো মানুষের ঘরে যায় খাবারের খোঁজে। সাপের অন্যতম খাবার ইঁদুর। মানুষ ঘরের মধ্যে খাবার রাখে, সেখানে ইঁদুর থাকে এবং সাপ সেসব খেতে যায়। অনেক সময় হাঁস, মুরগি পালার খোয়ারেও সাপ যায়। ইঁদুরের খোঁজে মানুষের ঘরে ঢোকে। অনেক সময় মানুষ ফ্লোরে শুয়ে ঘুমায় এবং সে সময় সাপ ঘরে প্রবেশ করলে মানুষের একটা হাত যদি  সাপের শরীরের উপর পরে বা পা লাগে তখন সাপ ভাবে যে মানুষ তাকে আক্রমণ করছে এবং তখন সাপ মানুষকে কামড় দেয়। এজন্য আমরা পরামর্শ দেই কেউ যদি ফ্লোরে ঘুমায় তাহলে যেন মশারি টাঙিয়ে ঘুমায়। মশারি তাকে অন্যান্য পোকামাকড় এবং সাপ থেকেও নিরাপত্তা দেবে। ঘরকে ইদুর মুক্ত রাখতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলছেন ঘরে কার্বলিক এসিড রাখলে সাপ আসবে না। এটা ভুল ধারণা। রাসায়নিক পদার্থ সাপের ঘরে আসা আটকাতে পারবে না।

/লিপি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়