ঢাকা     সোমবার   ০১ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৭ ১৪৩১

বৃষ্টিভেজা বিকেলে ঋদ্ধি প্রকাশনে

রাশিদা খাতুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৮, ২৯ জুন ২০২৪   আপডেট: ১৩:১১, ২৯ জুন ২০২৪
বৃষ্টিভেজা বিকেলে ঋদ্ধি প্রকাশনে

ঋদ্ধি প্রকাশন

এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে মিরপুর ১১-এর পূরবী সিনেমাহলের সামনে দাঁড়িয়ে এক ভদ্র মহিলা ফার্মগেটগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ফার্মগেট যেতে হলে রাস্তার উল্টোপাশে যাওয়ার পরামর্শ দিতেই অনেকটা ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন—যত যাই হোক রাস্তা উনি পার হবেন না। যাইহোক আমার গন্তব্য ঋদ্ধি প্রকাশন। ইসলামী হাসপাতালের গলি দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়েই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

বিল্ডিংয়ের প্রবেশমুখে একটি বক্স। কেউ চাইলেই ক্ষুধার্তদের জন্য ওই বক্সে খাদ্য জমা করে যেতে পারেন। পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের নিচতলায় ফুডকোর্ট বা ক্যাফেটেরিয়া। মানুষ পছন্দমতো খাবার খাচ্ছেন আর বই পড়ছেন। খালি টেবিলগুলোতে শোভা পাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ফুলের টব। এরপর দ্বিতীয় তলায় গেলাম। সেখানে যেতেই হাসিমুখে স্বাগত জানালেন বুকশপের দায়িত্বরত কয়েকজন তরুণ। শিশুদের উপযোগী নানা খেলনাসহ বই, খাতা, কলম, পেন্সিল সব কিছু থরে থরে সাজানো অভ্যর্থনা কক্ষে। এগুলো কিনে নেওয়ার সুযোগও রয়েছে।

ভেতরে লাইব্রেরির আদলে এই বুকশপ। ব্যাগ অভ্যর্থনা কক্ষে জমা রেখে ঢুকতে হয়। চাইলেই নিজের পছন্দের বই পড়া যায় এখানে। এমন সুযোগ যেখানে আছে সেখানে স্কুল পালানো কোনো শিক্ষার্থীকে পেয়ে যাওয়া বিরল ঘটনা নয়। আরেফিন সিদ্দিক আরাফ নামের এক শিক্ষার্থী মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলেন। বললেন, আজ ক্লাস করতে ভালো লাগছিলো না, স্কুল পালিয়ে এখানে এসেছি।

খেয়াল করলাম একজন নিবিষ্ট মনে নীলিমা ইব্রাহীমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটি পড়ছেন। ট্রিপল-ই এর এই শিক্ষার্থীর নাম তরু। তরু জানান, তিনি মিরপুর দুইয়ের বাসিন্দা। সময় সুযোগ পেলেই চলে আসেন ঋদ্ধিতে। মন ভালো না থাকলে এখানে চলে আসলেই নাকি তার মন ভালো হয়ে যায়। কখনো কখনো তরুর সঙ্গে আসে তার বর। সপ্তাহের শুক্রবারে বোনের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসেন তরু।

কারণ শুক্রবারে ঋদ্ধিতে শিশু কর্ণারে গল্প পাঠের আসর বসে। ৬ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এই আয়োজন করেছেন ঋদ্ধি প্রকাশন।

মার্কেটিং অফিসার আফিয়া ফারজানা মিতু বলেন, এখানে প্রতি শুক্রবার বিকাল ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত আমরা শিশুদের জন্য গল্পপাঠের আসর রেখেছি। একজন ম্যাম শিশুদেরকে গল্প শোনান। অনেক সময় শিশুরাও গল্প শোনায়। আমরা চাই শিশুদের পাঠ্যাভাস গড়ে উঠুক। 

শুক্রবারে শিশুরা তাদের পরিবারের বড় সদস্যদের সঙ্গে আসে। অনেক সময় ছয় বছরের কম বয়সী শিশুরাও আসে। তারাও গল্প শোনে। এতে নতুন একটি সোসাইটি গড়ে উঠছে, যাদের মধ্যে পরিচয়, হৃদ্যতা এবং চিন্তা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এসব কারণেই ধীরে ধীরে মিরপুরের বাসিন্দাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ঋদ্ধি প্রকাশন।

এই প্রকাশনের সমন্বয়কারী রাজীব উল্লাহ বলেন, ঋদ্ধি প্রকাশনের স্বপ্নদ্রষ্টা মাহবুবুল হাসান ফয়সাল বই পড়তে এবং সংগ্রহ করতে ভালোবাসেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনেক বই সংগ্রহ করেছেন। বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বইমেলা থেকে বই সংগ্রহ করেন ফয়সাল। তিনি চেয়েছেন ওই বইগুলো মানুষের কাজে লাগুক। জ্ঞানচর্চার একটি সামাজিক আবহ তৈরি করার প্রচেষ্টা হিসেবে গড়ে তুলেছেন ঋদ্ধি প্রকাশন। আমরা সেই স্বপ্নের পথ ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এখানে যারা একবার এসেছেন তারাই আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে অন্যদেরকে জানাচ্ছেন। এটিই আমাদের অনেক বড় পাওয়া। 

ঋদ্ধি প্রকাশনে গবেষকদের জন্য রয়েছে সমৃদ্ধ আর্কাইভ। রাজীব উল্লাহ বলেন, আর্কাইভে ঢুকতে হলে বিশেষ অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়। যেহেতু দুষ্প্রাপ্য এবং পুরনো বইপত্র, নথি রয়েছে সেজন্য সবার জন্য এটি উন্মুক্ত নয়। বিশেষত শিক্ষক, গবষকেরা আর্কাইভে পড়াশোনা করতে পারেন।

ঋদ্ধি সব স্তরের পাঠকের  কাছে সমাদর পাচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী আহসান হাবীব উপন্যাস পড়ছিলেন। তিনি বললেন, দুপুরের খাবারের পরে ঋদ্ধিতে চলে আসেন তিনি। 

আরেক শিক্ষার্থী আদ্রিতা কমিক্সের বই পড়ছিলেন। তিনি বলেন, ঋদ্ধিতে ঢাকা কমিক্সের অনেক বই পাওয়া যায়। এগুলো পড়তে ভালোলাগে। কিন্তু আমার  প্রিয় শাহরিয়ার কমিক্সগুলো এখানে নেই, আশা করছি ভবিষ্যতে শাহরিয়ারের কমিক্সও পাওয়া যাবে।
অ্যাকাউন্টস অফিসার রাকিব মল্লিক বলেন, আমাদের এখানে যেকোন বয়সের লোকজন আসতে পারেন। বিশেষ করে বইপ্রেমী লোকজন এখানে আসেন। বুকশপের কোনো বই পছন্দ হলে তারা সেটা ক্রয় করতে পারেন। তবে এখান থেকে বই বাসায় নিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। 

এখানে বই পড়তে হলে আপনাকে সদস্যও হতে হবে না। সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে ঋদ্ধি।
এই বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় রয়েছে অডিটোরিয়াম। সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য এটি ভাড়া দেওয়া হয়। একদিনের জন্য পরিশোধ করতে হয় ১০ হাজার টাকা। অর্ধবেলার জন্য ৫ হাজার টাকা। তবে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন বা সাংস্কৃতিক কোনো অনুষ্ঠান হলে কর্তৃপক্ষ বিশেষ ছাড়ে এই অডিটোরিয়াম ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে থাকেন। 

ঋদ্ধি প্রকাশনের এই আয়োজন দেখে এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে দ্বিতীয় তলায় বুকশপে অনেক লোকের সমাগম দেখতে পেলাম। নিচতলার ফুডকোডেও মানুষ গমগম করছিলো। তাদের হাতে হাতে বই। দেখতেই ভালো লাগছিল এই অচেনা পরিবেশ। এরপর বের হয়ে মিরপুর দশের দিকে রওনা দিলাম। এই শহরে কত-শত রেঁস্তোরা! ঋদ্ধির সঙ্গে পার্থক্য শুধু এখানেই যে সেগুলোতে বই নেই। মনে হলো, এতোক্ষণে হয়তো পূরবী সিনেমাহলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ভদ্রমহিলা হয়তো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। রাস্তা পার হয়ে ফার্মগেটগামী কোনো বাসে উঠে পৌঁছে গেছেন গন্তব্যে। আরও মনে হলো যারা শহরে একটু নিরবতা খোঁজেন, শিশুদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার জায়গা খোঁজেন তারাও ঋদ্ধির কথা জানবেন। একদিন ঋদ্ধির মতো শত শত বুকশপে ছেঁয়ে যাবে এ শহর! শহরে খেই হারানো মানুষেরা, বিশেষত শিশুরা খুঁজে পাবে সেই সব ঠিকানা। ঋদ্ধি প্রকাশনের স্বপ্নদ্রষ্টা মাহবুবুল হাসান ফয়সালের মতো আরও আরও স্বপ্নবাজ তরুণ নিশ্চয় পাল্টে দেবে আগামীর ঢাকা।

/লিপি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়