ঢাকা     শুক্রবার   ১৮ অক্টোবর ২০২৪ ||  কার্তিক ২ ১৪৩১

কালজয়ী লোকসংগীত শিল্পী আব্দুল আলীমের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী আজ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২১, ২৭ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৩:৩৩, ২৭ জুলাই ২০২৪
কালজয়ী লোকসংগীত শিল্পী আব্দুল আলীমের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী আজ

কালজয়ী লোকসংগীত শিল্পী আবদুল আলীমের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী আজ। দেশের লোকসংগীতের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এই শিল্পী লোকসংগীত ছাড়াও পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি গেয়ে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।

বাংলা গানের এই কিংবদন্তি শিল্পী ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি গ্রামোফোন (কলের গান) দেখে বিস্মিত হয়ে যান এবং মনের মধ্যে লালন করতে থাকেন কি করে ঐ গ্রামোফোনের গান গাওয়া যায়। আবদুল আলীমের নিজ গ্রামেরই সংগীত শিক্ষক সৈয়দ গোলাম ওলির কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। গ্রামের সকল পালা পার্বণে ক্ষুদে আব্দুল আলীম গান শুনিয়ে গ্রামের সকলের মনমাতাতে লাগলেন। সেই সময় সৈয়দ গোলাম অলি তাকে কোলকাতায় নিয়ে যান। কিছু দিন কোলকাতা থাকার পর ছুটে গেলেন তালিবপুরে। অজ পাড়াগাঁয়ে সংগীত শেখার কোন সুযোগ না থাকায় তার বড় ভাই শেখ হাবিব আলী আবার তাকে কোলকাতায় নিয়ে যান ।

১৯৪২ সাল। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছে। শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক এলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বড় ভাই শেখ হাবিব আলী আব্দুল আলীমকে নিয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে। আব্দুল আলীমের অজ্ঞাতে বড় ভাই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কাছে তার নাম দিলেন গান গাইবার জন্য। এক সময় মঞ্চ থেকে আবদুল আলীমের নাম ঘোষণা করা হলো। শিল্পী ধীর পায়ে মঞ্চে এসে গান ধরলেন-সদা মন চাহে মদিনা যাবো।

মঞ্চে বসে আবদুল আলীমের গান শুনে শেরে-বাংলা শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। কিশোর আলীমকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। উৎসাহ দিলেন, দোয়া করলেন এবং তখনই বাজারে গিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি জুতা-মোজা কিনে দিলেন। এরপর এক গীতিকার আবদুল আলীমকে কলকাতায় মেগাফোন কোম্পানিতে নিয়ে গেলেন। সেখানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয়। কবি নজরুল গান শুনে মুগ্ধ হন। রেকর্ড কোম্পানির ট্রেনারকে আবদুল আলীমের গান রেকর্ড করার নির্দেশ দেন। ১৯৪৩ সালে দু'টি ইসলামী গান রেকর্ড করলেন আবদুল আলীম। 

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের একমাস পূর্বে আবদুল আলীম কলকাতা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। ঐ বছরেরই ডিসেম্বরে ঢাকা এলেন। পরের বছর ঢাকা বেতারে অডিশন দিলেন। অডিশনে পাশ করলেন। ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে তিনি বেতারে প্রথম গাইলেন, ‘ও মুর্শিদ পথ দেখাইয়া দাও।’ 

এরপর পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের সাথে আবদুল আলীমের পরিচয় হয়। কবি জসীম উদ্দিন তাকে পাঠালেন জিন্দাবাহার ২য় লেনের ৪১ নম্বর বাড়িতে। একসময় দেশের বরেণ্য সঙ্গীত গুণী শিল্পীরা এখানে থাকতেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ মমতাজ আলী খানের কাছে তালিম গ্রহণ করেন। মমতাজ আলী খান আবদুল আলীমকে পল্লী গানের জগতে নিয়ে এলেন। পরবর্তীতে তিনি কানাই শীলের কাছে সংগীত শিক্ষা লাভ করেন। এদেশের পল্লীগান হলো মাটির গান। শিল্পী আবদুল আলীম মাটির গানকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিলেন। এর আগে তিনি ইসলামী গানসহ প্রায় সব ধরনের গান গাইতেন। 

লোকসংগীতের অমর কণ্ঠশিল্পী আববাস উদ্দিনের পরামর্শক্রমে তিনি ওস্তাদ মো. হোসেন খসরুর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম গ্রহণ করেন। তিনি পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে বেশ কিছুদিন চাকরিও করেন।

বিদেশে বাংলাদেশের পল্লীগানের মান বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে আবদুল আলীমের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বেতার ও টেলিভিশন ছাড়াও অসংখ্য ছায়াছবিতে গান করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এ কণ্ঠ দেন। এছাড়া আজান, রূপবান, জোয়ার এলাে, শীত বিকেল, এদেশ তোমার আমার, কাগজের নৌকা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সাত ভাই চম্পা, দস্যুরাণী, সুজন সখি-সহ অসংখ্য ছবিতে কণ্ঠ দেন।

১৯৬০ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার প্রথম গান- প্রেমের মরা জলে ডুবে না ও অসময় বাঁশী বাজায় কেরে এবং পরবর্তীতে- হলুদিয়া পাখী, দুয়ারে আইসাছে পাখি, নাইয়ারে নায়ে বাদাম তুইলা, এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া, পরের জাগা পরের জমিন- এসব গান অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। 

প্রথিতযশা এই শিল্পীর প্রায় ৫০০ গান রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া বেতারে স্টুডিও রেকর্ডেও প্রচুর গান রয়েছে। 

তিনি জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর বহু পুরস্কার লাভ করেন। এরমধ্যে একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার ও স্বাধীনতা পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। তিনি সংগীত কলেজের লোকসংগীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ছিলেন। 

আবদুল আলীমের সাত সন্তান। তাদের মধ্যে আজগর আলীম, জহির আলীম ও নূরজাহান আলীম পেশাদার সংগীতশিল্পী। শ্রোতামহলে পরিচিতি রয়েছে তাদের।

১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ঢাকা পি জি হাসপাতালে তিনি মারা যান।

/টিপু/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়