ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩১

কেন তৈরি হলো ফারাক্কা বাঁধ

সাতসতেরো ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২০, ২৮ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ০৮:৩০, ২৮ আগস্ট ২০২৪
কেন তৈরি হলো ফারাক্কা বাঁধ

ছবি: সংগৃহীত

চাঁপানবাবগঞ্জ থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ অবস্থিত। ১৯৬১ সালে গঙ্গা নদীর ওপর এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে। বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২.২৪ কিলোমিটার। এই অবকাঠামোটি সড়ক ও রেল যোগাযোগে সেতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফারাক্কা বাঁধের মোট ১০৯টি গেট রয়েছে। ফারাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে এই বাঁধ থেকেই জল সরবরাহ করা হয়। ভারতের অফিসিয়াল বিবৃতি অনুযায়ী, ১৯৫০-৬০ এর দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীর পলি ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করা হয়। হিন্দুস্তান কন্সট্রাকশন কোম্পানি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে একটি চুক্তিতে আসে। এই চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, উভয় দেশ একটি ‘চুক্তিতে’ আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। যদিও বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে মাত্র ১০ দিনের জন্য ভারতকে ৩১০ থেকে ৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়। কিন্তু ভারত ১৯৭৬ সালে গঙ্গা নদী থেকে ১১০০ কিউসেক পানি অপসারিত করে পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে।

পরবর্তীতে ভারতের এমন কাজ নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আলোচনা করা হলেও ভারতকে এই বিষয়টি খুব একটা আমলে নিতে দেখা যায়নি।  ১৯৭৫, ৭৮, ৮২ এবং ১৯৯২ সালে স্বল্পমেয়াদি পানিবণ্টন চুক্তি হলেও কোনোবারেই ভারত তার কথা মতো কাজ করেনি। ১৯৯৬ সালে হওয়া ৩০ বছর মেয়াদি ‘গঙ্গাচুক্তিতে’ যেভাবে বলা আছে সেভাবে পানি বণ্টন হয়নি। ভারত বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী, নদীতে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক। এর বেশি থাকলে ৪০ হাজার কিউসেক পাবে ভারত বাকিটা পাবে বাংলাদেশ। 

আরো পড়ুন:

এই বাঁধের ফলে শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বাঁধ থেকে হুগলি নদী পর্যন্ত ফিডার ক্যানেল বা খাল খনন করা হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এর যৌথ প্রভাবে বাংলাদেশ, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গে দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশ অংশের পদ্মা ২৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নাব্যতা হারিয়েছে। এ ছাড়া ৪৯টি শাখা নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। 

বিহার ও উত্তরপ্রদেশে প্রতিবছর বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে গঙ্গা বাহিত পলির পরিমাণ দুই বিলিয়ন টন থেকে এক বিলিয়ন টনে নেমে এসেছে। ফলে ভূমি গঠন এবং ভূমি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ব্যহত হয়েছে। আর্থিকভাবে বাংলাদেশে প্রত্যেক বছর প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়। পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় পানির স্তর ৮ থেকে ১০ ফুটের জায়গায় ১৫ ফুট নিচে চলে গেছে। পদ্মা বিধৌত অঞ্চল সমূহে শুষ্ক মৌসুমে মাটির আদ্রতা কমে যায় ৩৫ শতাংশ। ফলে দিনের উচ্চতম এবং নিম্নতম তাপমাত্রার তারতম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের গড়াই নদী প্রায় বিলুপ্তির পথে। খুলনা অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা বেড়েছে। মিঠা পানির অভার দেখা দিয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের মৎস সম্পদ। 

যে কলকতা বন্দর টিকিয়ে রাখার জন্য এই বাঁধ নির্মাণ হয়েছিল , এখনও সেই কলকাতা বন্দর প্রতিবছর যে পরিমাণ ড্রেজিং করতে হয় ফারাক্কা বাঁধ চালু করার আগেও এতো ড্রেজিং দরকার হতো না। শুধুমাত্র বাঁধের কারণে বন্যার পরিমাণও বেড়েছে। আধুনিক বড় জাহাজগুলো কলকাতা বন্দরে ভীড়তে পারে না। মাঝারি আকারের প্যানামাক্স জাহাজও এই বন্দরে ভীড়তে পারে না। এমনকি এই জাহাজের লোড অর্ধেক কমালেও নয়। এই বাঁধের ফলে গঙ্গা নদীর প্রায় ৩০ বর্গ কিলোমিটার সাগরে নিমজ্জিত হয়েছে। পলি আসা কমে যাওয়ায় সাগর এগিয়ে এসেছে এবং ভূমি গ্রাস করেছে। 

২০১৬ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক ও রেল যোগাযোগ ঠিক রেখে এই বাঁধের গেটগুলো অপসারণ করা সম্ভব। নদীতে বাঁধ দেওয়ার পরে যদি লাভের থেকে ক্ষতি বেশি হয় তাহলে ইউরোপ আমেরিকায় অনেক বাঁধ তুলে ফেলার নজির রয়েছে। 

লিপি

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়