মায়া তোচিলাশভিলির ফটোগ্রাফি ও ভাবনার জগত
মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম ও স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম
মায়া তোচিলাশভিলি, জর্জিয়ান ফটোগ্রাফার
জর্জিয়ান ফটোগ্রাফার মায়া তোচিলাশভিলি। তিনি জর্জিয়ার পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে দেশের প্রকৃতি, সৌন্দর্য আর সম্ভাবনার চিত্র ক্যামেরায় তুলে আনতে পছন্দ করেন। ২০১২ সাল থেকে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপরে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরষ্কার অর্জন করেছেন তিনি। ‘ওয়েলকাম টু জর্জিয়া, ন্যাশনাল টুরিজম অ্যাওয়ার্ড ২০২২’-প্রতিযোগিতায় বেস্ট ফটোগ্রাফার নির্বাচিত হন মায়া। এ ছাড়াও তিনি অর্জন করেছেন ‘ন্যাটো ইন জর্জিয়া ২০২১’, ‘কোলগা তিবিলিসি ফটো ২০২৩’, ‘লেন্স কালচার আর্ট ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড ২০২২’, ‘রয়্যাল সোসাইটি অফ বায়োগ্রাফি ২০২৩’ সহ আরও অনেক পুরস্কার। করোনা মহামারি চলাকালে তিনি একটি প্রকল্প হাতে নেন। এটির নামকরণ করেন ‘জর্জিয়া সিন ইন ব্রোঞ্জ’। এই প্রকল্পের আওতায় মায়া জর্জিয়া ব্রোঞ্জের মূর্তি এবং গির্জার ছবি যুক্ত করেন। এবং ‘জর্জিয়া সিন ইন ব্রোঞ্জ’ নামে ফটো ক্যাটালগ প্রকাশ করেন।
মায়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পেশাদার ফটোগ্রাফি পরিষেবাগুলোর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আমার কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে, আমি বিজ্ঞাপন ফটোগ্রাফি, বিয়ের ছবি, ব্যক্তিগত এবং প্রতিকৃতির ছবি তুলে থাকি। এ ছাড়াও শিশুদের ফটোশ্যুটসহ আরও বিষয়ভিত্তিত ছবি তুলে থাকি। উচ্চ-মানের ছবি সরবরাহ করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় সংস্থার সাথে কাজ করি।’
মায়া তোচিলাশভিলি
মানসিক প্রশান্তির জন্য তিনি যতটা সম্ভব ভ্রমনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেন। এবং এই ভ্রমণের সময়, তিনি ল্যান্ডস্কেপ এবং ভ্রমণ-সম্পর্কিত ছবি তোলা উপভোগ করেন। তিনি বলেন, ‘ছবি তোলার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই একটি নতুন দিক বেছে নেই। এই পরিবর্তন শুধুমাত্র একটি নতুন চ্যালেঞ্জ নয়, এটি আমার সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় নতুন শক্তি যোগ করে এবং আমার কাজে আরও বৈচিত্র্য আনে। এইভাবে, আমার সৃজনশীলতা সর্বদা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধারণার প্রতিফলন ঘটাই।’
মায়া একজন রসায়নবিদ। কিন্তু ক্যারিয়ার গড়েছেন ফটোগ্রাফিতে। প্রথম দিকে ছবি তুলে তিনি নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতেন। পরিচিতজনদের প্রশংসা পেতেন। এই প্রশংসা তার কাজের গতি এবং আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে একটা সময় তিনি নিজের তোলা ছবি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন এবং সফলতা পান, আরও এগিয়ে যেতে থাকেন।
মায়া তোচিলাশভিলির ক্যামেরায় জর্জিয়ান নারী
মায়ার ভাষায়, ‘ফটোগ্রাফি একটি ভিন্ন জগত। যেখানে আমি একটি মুহূর্ত ক্যাপচার করতে পারি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, সম্ভবত শতাব্দীর জন্যও সংরক্ষণ করতে পারি। আমি এমন ছবি তৈরি করা উপভোগ করি যা দর্শকের ওপর একটি শক্তিশালী ছাপ ফেলে। আমি ভ্রমণ করতে পছন্দ করি, কারণ এটি আমাকে ছবি তোলার এবং আমার চোখের মাধ্যমে বিশ্বকে শেয়ার করার সুযোগ দেয়—সেটি ল্যান্ডস্কেপ, প্রতিকৃতি বা ডকুমেন্টারি- যে কাজই হোক না কেন।’
মায়া একটি সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করেন। তিনি দিনের শুরুটা করেন প্রার্থনা দিয়ে। প্রাতঃরাশের পরে, সারাদিন কখন কোন কাজ করবেন তার জন্য প্রস্তুতি নেন। মায়া বলেন, ‘আমার যদি ফটো সেশনের দিন থাকে, আমি তার জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। শ্যুট শেষ হয়ে গেলে, আমি ফটো এডিটিং প্রক্রিয়া শুরু করি, যার জন্য অনেক সময় এবং মনোযোগ প্রয়োজন এবং কয়েক দিন বা এমনকি সপ্তাহও লাগতে পারে। আমি আমার পরিবারের সাথে আমার অবসর সময় কাটাই। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে সময় কাটাই, কনসার্টে যোগ দিই বা সিনেমা দেখি। সপ্তাহান্তে আমি গির্জায় যাই।’
মায়া তোচিলাশভিলির ক্যামেরায় জর্জিয়া
জর্জিয়ায় নারীদের জীবন কেমন? প্রশ্নের জবাবে মায়া বলেন, ‘বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে জর্জিয়ান নারীরা প্রাথমিকভাবে পরিবারের দায়িত্ব নিয়োজিত ছিল। বাচ্চাদের লালন-পালন করা পরিবারের অর্থনৈতিক বিষয়ের যত্ন নেওয়া তাদের কাজের অন্তর্ভুক্ত। তাদের ঐতিহ্যবাহী এসব ভূমিকা সত্ত্বেও জর্জিয়ান নারীরা প্রায়শই জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেন যা দেশের ইতিহাসে একটি স্থায়ী স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। জর্জিয়ান নারীরা রাষ্ট্রীয় শ্রেণিবিন্যাসের সর্বোচ্চ স্তরে নিযুক্ত হন। উদাহরণস্বরূপ আমরা রানি তামারের নাম বলতে পারি যিনি ১২ শতকের শেষের দিকে এবং ১৩ শতকের প্রথম দিকে জর্জিয়া শাসন করেছিলেন। সেইসাথে রানি রুসুদানের নামও বলা যায়। তিনি ১৩ শতকের প্রথমার্ধে জর্জিয়া শাসন করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য জর্জিয়ান রানি তামারকে জর্জিয়ান ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী রাজা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার রাজত্ব জর্জিয়ান ইতিহাসে ‘সোনালি যুগ’ নামে পরিচিত। এ সময়ে জর্জিয়ায় সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল। রানি তামার এবং রুসুদান ছাড়াও, জর্জিয়ান ইতিহাসে আরো এক রানির বিশেষ স্থান রয়েছে। রানি কাখেতির কেতেভান ১৭ শতকে জর্জিয়া শাসন করেছেন। তিনি মুসলিম এবং খ্রিস্টান উভয়ের কাছেই সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। আধুনিক জর্জিয়ান নারীরা সারা বিশ্বের অন্যদের মতো নানান প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি এখন। তা সত্ত্বেও, অনেক জর্জিয়ার নারী সফলভাবে ব্যবসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।’
জর্জিয়া পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ার একটি আন্তঃমহাদেশীয় দেশ। তবুও দেশটির সাধারণ মানুষ নিজেদেরকে এশিয় না ভেবে ইউরোপীয় হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন। এর কারণ কী? জানতে চাইলে মায়া বলেন, ‘জর্জিয়ার মানুষ নিজেদেরকে ইউরোপীয় বলে মনে করার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। জর্জিয়া হল- ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত, এশিয়া ও ইউরোপের ভৌগলিক সংযোগস্থলে। কয়েক বছর আগে, দমনিসিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময়, প্রাচীন মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল যা প্রায় ১.৮ মিলিয়ন বছরের পুরনো। এমন প্রাচীন মানব দেহাবশেষ কেবল জর্জিয়াতেই নয় সমগ্র ইউরোপ মহাদেশ জুড়েই আছে। জর্জিয়ার মানুষের শারীরিকভাবে যেমন ফর্সা, ত্বক, মুখের বৈশিষ্ট্যসহ গঠন, চোখের রঙ এবং অন্যান্য বিষয় পৃথিবীর গোলার্ধের মাঝারি অক্ষাংশে বসবাসকারী মানুষের সাথে মেলে। প্যালিওনথ্রোপলজিক্যাল উপকরণ গবেষণায় পাওয়া গেছে যে জর্জিয়ানরা নিঃসন্দেহে দক্ষিণ ইউরোপিড। আমরা জানি, মানুষের মধ্যে জাতিগত পার্থক্য নির্দিষ্ট জলবায়ুতে দীর্ঘমেয়াদী বসবাসের কারণে হয়। প্রধান জাতিগুলো হল: সাদা (বা ইউরোপিড), কালো (বা নিরক্ষীয়-নিগ্রোয়েড), এবং হলুদ (বা মঙ্গোলয়েড)। এখানে উল্লেখ্য যে- জর্জিয়ান ভাষা এবং লেখা যা আইবেরিয়ান-ককেশীয়দের অন্তর্গত এবং এর মধ্যে বিদ্যমান অন্য কোনো ভাষার সাথে কোনো জেনেটিক সংযোগ নেই। ইউরেশিয়া মহাদেশে ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জর্জিয়ার একটি অনন্য কৌশলগত অবস্থান রয়েছে। প্রাচীন কাল থেকে, জর্জিয়ার এশিয়া এবং ইউরোপীয় উভয় সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, বিশেষকরে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে। ‘সিল্ক রোড’ এর ইতিহাসকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। জর্জিয়া দীর্ঘকাল ধরে ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে মধ্য এশিয়ার সংযোগ হিসেবে কাজ করেছে যা সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। জর্জিয়ার সমাজ, বিশেষ করে ২০শতকের শেষে এবং ২১শতকের মধ্যে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং এর সাথে একীকরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেশটির ইউরোপীয় মূল্যবোধের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।’
মায়া তোচিলাশভিলির ক্যামেরায় জর্জিয়া
মায়া নিজের দেশ, প্রকৃতিকে ভালোবাসেন। নিজের দৃষ্টিতে দেখা জজর্জিয়ার প্রকৃতি অন্যদের কাছে জীবন্ত করে তুলতে চান। ফটোগ্রাফি ছাড়া নিজের জীবন কল্পনাও করতে পারেন না মায়া তোচিলাশভিলি।
ঢাকা/লিপি