বাংলাদেশ ও পৃথিবীর আলোচিত যত ছাত্র আন্দোলন
পৃথিবীর প্রথম ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল চীনে। ছবি: সংগৃহীত
পৃথিবীর দেশে দেশে নিজেদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে ছাত্ররা। বিশ্বের নানা আলোচিত ঘটনা ও সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে তারা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। পৃথিবীর প্রথম ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল চীনে। বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস হয়েছে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবে। চলুন বিস্তারিত জানা যাক।
প্রথম ছাত্র আন্দোলন: ইতিহাসে প্রথম ছাত্র আন্দোলন হয়ে চীনে, ১৬০ খ্রিস্টাব্দে। ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তখন সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল। তাদের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন কিছু মেধাবী ছাত্রনেতা। যারা তুলনামূলক ভাবে উঠে এসেছিলেন গরিব পরিবার থেকে। তাদের আন্দোলন সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। ছাত্রদের সঙ্গে একাগ্রতা প্রকাশ করতে অংশ নিয়েছিলেন ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। সে সময়কার চীন সরকার ওই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করেছিলেন। কারাগারে বন্দী করেছিলেন ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে।
ফরাসি বিপ্লব ও বোহেমিয়ান বিদ্রোহ: ফরাসি বিপ্লবের সময় ছাত্ররাও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল। রাজা ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল ফ্রান্সের শিক্ষার্থীরা। তারা নতুন এবং গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছিল। ১৮৪৮ সালের বোহেমিয়ান বিদ্রোহের সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশ নেয়। তারা তাদের নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই শুরু করে।
হোয়াইট রোজ আন্দোলন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে এক অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা হোয়াইট রোজ নামের একটি গ্রুপ সৃষ্টি করে নাৎসি শাসনের নির্মমতার বিরুদ্ধে জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য লিফলেট বিতরণ করে। যা নাৎসি সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে সহায়তা করেছিল। ১৯৪৩ সালে এদেরকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিচার শেষে ছয় জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
ভাষা আন্দোলন: ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেছিল ঢাকার ছাত্ররা। শহিদ হয় রফিক, শফিক, বরকতসহ অনেকেই। শিক্ষার্থীদের রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা।
গ্রিনসবোরো অবস্থান ধর্মঘট: যুক্তরাষ্ট্রের উলনর্থ ক্যারোলিনার মধ্যাহ্নভোজের কাউন্টারে সাদা কালো ভেদাভেদের প্রতিবাদে চারজন কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে শীঘ্রই যোগ দেয় আরো ৩০০ শিক্ষার্থী এবং এরপর এ আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাঞ্চ কাউন্টারে বর্ণবৈষম্য দূর করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় ৬৪ সালের পাশ হয় নাগরিক অধিকার আইন। পরে এই আন্দোলন মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নেয়। ২০০৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করা চার শিক্ষার্থীর একজন ম্যাককেইন বলেন, “অনিবার্যভাবেই লোকজন প্রায়ই আমাকে বলে থাকে- আমি এখন কী করব? আমি তাদের বলি, এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তোমার চারপাশে তাকাও। একসময় তুমিই দেখতে পাবে- তুমি কী করতে চাও। তবে সাধারণ মানুষের কাছে কখনো প্রত্যাশা কোরো না। কারণ, তারা আসবে না।’’
মে ১৯৬৮ মুভমেন্ট: ফ্রান্সের ১৯৬৮ সালের মে মুভমেন্ট ছিল একটি বিশাল ছাত্র আন্দোলন। ফ্রান্সের শিক্ষার্থীরা সামাজিক ন্যায় বিচার ও শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
৬৯ এর গণঅভ্যুথান: ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে ফুটে ওঠে বাংলাদেশের ছাত্র জনতারা। পাকিস্তান রাষ্ট্র আলাদা হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশিদের (পূর্ব পাকিস্তানের) প্রতি যে অত্যাচার করে আসছিল পাকিস্তানিরা, সেসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন বাংলাদেশকে এগিয়ে দেয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সকল পেশার মানুষের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। এতে অংশ নেয় ছাত্ররাও। পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। সম্মুখ যুদ্ধে বিভিন্ন বাহিনীতে ছাত্রদের ভূমিকা ছিলো অগ্রণী।
জাতিবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন: দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়াতের পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা বর্ণবৈষম্য এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭৬ সালের ১৬ই জুন জোহরেরবার্গের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেয়। সেই আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালালে অনেক শিক্ষার্থী নিহত হয়। এই আন্দোলন ১৯৯৪ পর্যন্ত চলেছিল। এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত দেশটির বর্ণ বৈষম্য বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রথম ঘটায়। এরপর নেলসন ম্যান্ডেলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়।
তিয়েন আনমেন স্কয়ার আন্দোলন: ১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল চীনের সাবেক কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব ও উদারবাদী রাজনৈতিক ও অর্থনীতি পুনর্গঠনকারী হু ইয়াওবাংয়ের মৃত্যুকে ঘিরে একটি বিক্ষোভ শুরু হয়। তার স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শোভাযাত্রা নিয়ে তিয়েন আনমেন স্কয়ারে একত্রিত হতে থাকে। ওই দলটি মুদ্রাস্ফীতি, চাকরির সীমিত সুযোগ ও পার্টির অভ্যন্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে হু সোচ্চার ছিলো। বিক্ষোভকারীরা সরকারের স্বচ্ছতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও শিল্প-কারখানায় নিয়োজিত কর্মীদের অধিকারের বিষয়ে দাবি উত্থাপন করে। বিক্ষোভের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সমবেত হন। পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ছিলো আন্দোলনের নেতৃত্বে।
মখমল বিপ্লব: ১৯৮৯ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার শিক্ষার্থীরা সমাজতান্ত্রিক সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন জনসমুদ্রে পরিণত হয়, এতে অংশ নেয় ৫ লাখের অধিক মানুষ। এই আন্দোলনের সাথে কস্তাবি কি আর কমেন্টস পার্টি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। ২৮ নভেম্বর পদত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টি। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন: ১৯৯০ সালে ছাত্ররা এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। এই আন্দোলনে ছাত্ররা সরাসরি অংশ নেয় এবং এতে এরশাদ সরকারের পতন হয়।
ইরানের ছাত্র বিক্ষোভ: ১৯৯৯ সালের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে পুলিশের অভিযান এবং শিক্ষার্থীদের উপর হামলার পর ইরানের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। এই আন্দোলনের ফলে ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পুলিশের অভিযানের সমালোচনা করে এবং সংজমের আহ্বান জানায়। এই আন্দোলন ইরানে ব্যাপক ভুমিকা পালন করে।
শাহবাগ আন্দোলন: ২০১৩ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে জড়ো হয় লাখো মানুষ। এ সময় ছাত্ররা গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা যুদ্ধ অপরাধ করেছিল তাদের শাস্তির জন্য রাস্তায় নামে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।
কোটা সংস্কার আন্দোলন: ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। এই কোটা সংস্কার আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন ২০১৮: ২০১৮ সালের ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন পায়।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন: ২০২৪ সালে ছাত্রদের ঢাকায় আন্দোলনে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। ছাত্রদের এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সর্বস্তরের মানুষ।
ঢাকা/লিপি