ঢাকা     সোমবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

পোড়াবাড়ির চমচম

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩০, ৬ জুলাই ২০১৩   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
পোড়াবাড়ির চমচম

শাহরিয়ার সিফাত
টাঙ্গাইল, ৬ জুলাই : টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম। যার নাম শুনলেই জিভে পানি আসে। পোড়া ইটের মত রঙ আর সুস্বাদু চমচমের কড়া মিষ্টির আবরণ। যার ভেতর রয়েছে গোলাপী আভাযুক্ত নরম অংশ।

মিষ্টান্ন জগতে অনন্য স্বাদের  পোড়াবাড়ি চমচমের সুনাম বৃটিশ আমলেই ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে। আর কালের পরিক্রমায় পোড়াবাড়ির মিষ্টির খ্যাতি টাঙ্গাইলকে পরিচিতি করে তুলেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে।

বর্তমানে এই সুনাম ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। অতি মুনাফা লোভী কিছু ব্যবসায়ীদের কারনে ঐতিহ্য হারানোর আশংকায় পড়েছে চমচমের আসল ব্যবসায়ীরা। দেখা দিয়েছে দক্ষ কারিগরের অভাবও। ফলে অনেকেই ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম তৈরির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এতে ঐতিহ্যবাহী এই পোড়াবাড়ি চমচম আজ অস্তিত্ব সংকটে।

ত্রিশ দশকের শেষদিকে আসামের রামেন্দ্র ঠাকুর, তীর্থবাসী ঠাকুর টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারে মিষ্টি তৈরীসহ ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকেই পাঁচআনী বাজার মিষ্টিপট্টি নামে পরিচিত লাভ করে।

পোড়াবাড়ি চমচম তৈরির কারিগররা জানায়, টাঙ্গাইলের  চরাঞ্চল গরুর দুধ সংগ্রহ করে নিজেরাই ছানা বানিয়ে চমচম বানানো হয়। সুদীর্ঘকাল ধরে বংশ পরম্পরা এভাবেই চমচম তৈরি করা হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এ নিয়ম মানছে না অতি মুনাফা প্রত্যাশা কিছু ব্যবসায়ী।

কারিগররা আরও জানায়, এক ধরনের মেশিনে দুধ ভাঙ্গানোর পর তা থেকে পাওয়া বর্জ্য দিয়ে ছানা বানিয়ে এখন চমচম তৈরি হচ্ছে। স্বাদে ও গন্ধে এসব চমচম প্রকৃত পোড়াবাড়ির চমচমের স্বাদের ধারে কাছেও নেই। অথচ দামে খুব একটা পার্থক্য নেই।

মিষ্টি ব্যবসায়ীরা জানান, প্রকৃত মিষ্টি ব্যবসায়ীরা চরাঞ্চল ও বিভিন্ন গ্রামে থেকে গরুর দুধ সংগ্রহ করে। আর অসাধু ব্যবসায়ীরা মিষ্টি তৈরি করে পাবনা থেকে আনা ছানা দিয়ে।

প্রতিদিন পাবনা জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রায় ৫শ’ কেজি ছানা আসে শুধু মাত্র শহরের পাঁচআনী বাজারের মিষ্টি দোকানগুলোতে। এভাবে ভেজাল ছানার দৌরাত্মে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে।

প্রতিদিন পাঁচআনী বাজারের ২৮/৩০ দোকনে উৎপাদিত প্রায় তিন হাজার মিষ্টি। সেখান থেকে সরবরাহ হয় ঢাকাসহ সারাদেশে। সর্বোচ্চ ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়ে থাকে। যা জেলার বাইরে বিক্রি হয় আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত।

প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব ও সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে বংশানুক্রমে চলে আসা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা। একদিন যে গ্রামটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল  পোড়াবাড়ির চমচমের ভান্ডার। সে গ্রামটিতে আজ মিষ্টি উৎপাদন নেই বললেই চলে।

পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া পোড়াবাড়ির মিষ্টি ব্যবসায়ী গদন চন্দ্র গৌড় বলেন, এ গ্রামে বর্তমানে ১২/১৩টি বাড়িতে মিষ্টি তৈরি হচ্ছে। গ্রামের মানুষগুলো অর্থের অভাবে টিকে থাকতে পারছে না ব্যবসায়।

শহরের পাঁচআনী বাজারের মিষ্টি ব্যবসায়ী সীমান্ত সরকার পরিমল জানান, বর্তমান অবস্থায় এ ব্যবসা কঠিন হয়ে পড়েছে। পোড়াবাড়ি চমচমের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সকলের উদ্যোগী হওয়ার সময় এসেছে।

নিন্মমানের ও ভেজাল মিষ্টির বিষয়টি সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন টাঙ্গাইল জেলা হোটেল ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ। তিনি বলেন, কেউ কেউ হয়তো মিষ্টির তৈরির সময় ময়দার পরিমান একটু বাড়িয়ে দেয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মিষ্টি ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে শ্রমিক সংগঠনের নামে স্বার্থান্বেষী একটি মহল ভর করে মিষ্টি ব্যবসার উপর। বিশেষ এ মহলের কারনে ব্যবসায়ীদের হয়রানীর শিকার হতে হয়। আর তার সাথে রয়েছে প্রশাসনের মোবাইল কোর্টের অত্যাচার।

প্রায়ই এসব মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেট এসে মিষ্টিতে মাছি থাকার কারনে আমাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করে। কিন্তু সঠিকভাবে ও ভেজাল মুক্ত মিষ্টি বানানোর কারনে মিষ্টিতে সামান্য মাছি বসবেই। যদি আমরা ভেজাল মিষ্টি তৈরী করি তবেই এই মাছি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার পশ্চিমেই পোড়াবাড়ির অবস্থান। এককালে প্রমোত্ত ধলেশ্বরীর পূর্ব তীরে পোড়াবাড়ি নামক স্থানে গড়ে উঠেছিলো জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র। তখন এদেশে ব্রিটিশরা সবে ঔপনিবেশিক শাসন শুরু করেছে। ওই সময়ের উন্মাদিনী ধলেশ্বরী নদীর ঘাটে ভিড়তো বহু স্টিমার, লঞ্চ আর মালবাহী বড় বড় নৌকা।

ঢাকা-কলকাতাগামী স্টিমারের ভেপুর শব্দে পোড়াবাড়ি, চারাবাড়ির কুলবধু থেকে শুরু করে শিশু, কিশোর, যুবক বৃদ্ধ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতো।

যাত্রী বোঝাই লঞ্চ, স্টিমার ঘাটে ভিড়তো। আর সেসব লঞ্চ-স্টিমার থেকে নেমে আসতো দেশী বিদেশী হরেক রকমের মানুষ। এ সময় থেকেই পোড়াবাড়ি জনসমাগমে ভরপুর। তখন এই পোড়াবাড়ির পল্লী ধলেশ্বরী নদীর মাতৃস্নেহে গড়ে ওঠে মোহনীয় মিষ্টি শিল্প চমচম।

 

রাইজিংবিডি/ইভা/শামটি/এলএ








রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়