ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মহানায়কের নেপথ্যচারিণী মহীয়সী

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৩, ৮ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহানায়কের নেপথ্যচারিণী মহীয়সী

এসকে রেজা পারভেজ : ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছো, লেখো তোমার জীবনের কাহিনি। বললাম, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’

‘...আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেণু- আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কটা আমাকে দিয়েছিল। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’

এভাবেই বঙ্গমাতার উৎসাহে বঙ্গবন্ধু কারাগারে থেকেই লিখেছিলেন তার নিজের হাতে লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। শুধু আত্মজীবনী লেখাতেই বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহ দেননি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, বরং জীবনের প্রতিটি বাকে বাকে, প্রতিটি সংকটে পাশে থেকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নেপথ্যচারিণী ও প্রেরণাদায়িনী মহীয়সী।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের যে কাল রাতে কতিপয় ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত কুলাঙ্গার বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে, জীবনের সেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেগম মুজিব ছিলেন ইতিহাসের কালজয়ী এক মহানায়কের অনুপ্রেরণাদায়িনী হিসেবে। বঙ্গমাতার অবদান বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয় একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবেও, যিনি নেপথ্যে থেকে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের বেশিরভাগ কেটেছে বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, যেখানে আড়ালে থেকে সাহস যুগিয়েছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর বিদেশ সফর, রাষ্ট্রীয় কর্মযোগ, কোন উৎসব আয়োজন কিংবা জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতেও তাকে সেভাবে বঙ্গবন্ধুর পাশে দেখা যেত না। পরবর্তীতে একটি স্বাধীন জাতির স্থপতি কিংবা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিপতির স্ত্রী হিসেবেও তার কোন বিশেষ পরিচিতি ছিল না। কিন্তু দুঃসময়ে, মহাসঙ্কটে, আন্দোলন সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলোতে বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহ দিয়েছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সফলতার জন্য যে নারীর ত্যাগ-তিতীক্ষার কাছে ঋণী তিনি হলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে, সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। কারাবন্দি করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। ছেলেমেয়ে নিয়ে বহু কষ্ট আর অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি সংসার চালিয়ে যান। স্ত্রীর এই ত্যাগের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু একটি ঘটনা প্রসঙ্গে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। সেখানে প্রসঙ্গক্রমে অনেকবার এসেছে বঙ্গমাতার নাম। পরিবারের জন্য হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তার লেখায় দেখা গেছে।

‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো’। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়!...’

‘দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’

জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভেতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, ‘বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে। ‘রাসেল’ আব্বা আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না’, লিখেছেন বঙ্গবন্ধু।

মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আত্মত্যাগের কথা বলতেও বঙ্গবন্ধু ভোলেননি।

‘সংসারের কথা, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, আব্বা আম্মা’র শরীরের অবস্থা আলোচনা করতে করতে চলে যায়। কোম্পানি আজও আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেয় নাই, তাই একটু অসুবিধা হতে চলেছে বলে রেণু বলল। ডিসেম্বর মাসে আমি চাকরী ছেড়ে দিয়েছি- চারমাস হয়ে গেল আজও টাকা দিল না! আমি বললাম, ‘জেল থেকে টেলিগ্রাম করব। প্রথম যদি না দেয় তবে অন্য পন্থা অবলম্বন করব। আমার টাকা তাদের দিতেই হবে। কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও। বাড়ির থেকে চাউল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাংকেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। আমার যথেষ্ট বন্ধু আছে যারা কিছু টাকা ধার দিতে কৃপণতা করবে না। যদি বেশি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব’, রেণু বলল। সরকার যদি ব্যবসা করতে না দেয় তবে বাড়িতে যে সম্পত্তি আমি পেয়েছি আব্বার, মায়ের ও রেণুর তাতে আমার সংসার ভালভাবে চলে যাবে। রেণু বলল, ‘চিন্তা তোমার করতে হবে না।’ সত্যই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি’।’

বঙ্গবন্ধু তার ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের অগণিত স্থানে তার সহধর্মিণীর প্রতি গভীর ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস ও পরম নির্ভরতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে বেগম মুজিবের ধৈর্য, ত্যাগ ও অবদানের বিবরণ দিয়েছেন।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে যিনি ছায়ার মতো পাশে থেকে দিকনির্দেশনা, পরামর্শ, সাহস, প্রেরণা দিয়ে গেছেন তাকে স্মরণ করতে না পারলে জাতির ঋণ কোনদিন শোধ হবে না।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ আগস্ট ২০১৯/রেজা/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়