বছরজুড়ে ডেঙ্গুর উপদ্রবে মৃত্যুর ইতিহাস
ছবি: প্রতীকী
২০২৩ সালে দেশে করোনার সংক্রমণ নিম্নমুখী থাকলেও, মৃত্যু ছিল প্রায় শূন্যের কোটায়। বিশ্বের অনেক দেশের আগেই করোনা ধাক্কা সামলে উঠেছে বাংলাদেশ। তবে, চলতি বছরে ভয়ঙ্কর রূপে দেখা দিয়েছে এডিস মশাবাহিত ভাইরাস ‘ডেঙ্গু’। বছরের পুরো সময় ডেঙ্গুর উপদ্রবে নাকাল হয়েছেন দেশের মানুষ। ‘সিজনাল রোগ’ হিসেবে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের হিসাব বলছে, চলতি বছরের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু-আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৬৯২ জন। একই সময়ে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে এর আগের বছরে (২০২২ সাল) মারা গেছেন ২৮১ জন।
মাসের হিসাবে দেশে ডেঙ্গু-আক্রান্ত হয়ে সেপ্টেম্বরে ৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা দেশের ইতিহাসে কোনও মাসে মশাবাহিত রোগে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে, গত অক্টোবর মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ১৯৩ জন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৩টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৬৭ জন। দেশের অন্যান্য বিভাগে ভর্তি আছেন ৮২৬ জন।
মাসের হিসাবে ডেঙ্গু-আক্রান্ত হয়ে জানুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে এক হাজার ৩৬, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৭৬, আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬, সেপ্টেম্বরে ৭৯ হাজার ৫৯৮, অক্টোবরে ৬৭ হাজার ৭৬৯ এবং নভেম্বরে ৪০ হাজার ৭১৬ জন। আর চলতি ডিসেম্বরের ২২ দিনে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ১৮০ জন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু-আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ২০ হাজার ১৫৮ জন। এর মধ্যে, ঢাকায় ১ লাখ ৯ হাজার ৭৪৩ ও ঢাকার বাইরে ২ লাখ ১০ হাজার ৪১৫ জন। অপরদিকে, হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩ লাখ ১৭ হাজার ২৭৩ জন ডেঙ্গুরোগী। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ১ লাখ ৮ হাজার ৪০১ ও ঢাকার বাইরে ২ লাখ ৮ হাজার ৮৭২ জন।
এ বছর ডেঙ্গুতে প্রথম মৃত্যু হয় জানুয়ারি মাসে। পুরো জানুয়ারি মাসে ৬ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফেব্রুয়ারিতে ৩, মার্চে কেউ মারা যাননি, এপ্রিল ও মে মাসে ২ জন করে মারা গেছেন। এরপর লাফিয়ে বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যা। জুন মাসে ৩৪, জুলাই ২০৪, আগস্টে ৩৪২, সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ৩৯৬, অক্টোবরে ৩৫৯, নভেম্বরে ২৭৪ এবং ডিসেম্বরের ২২ তারিখ পর্যন্ত মারা গেছেন ৭০ জন। দিনের হিসাবে ডেঙ্গুতে এক দিনে সর্বোচ্চ মারা গেছেন ১৫ নভেম্বর ২৪ জন এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ২ ও ২০ সেপ্টেম্বর ২১ জন করে।
পক্ষান্তরে, ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে প্রথম মৃত্যু হয় জুন মাসে। পুরো জুন মাসে এক জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর জুলাইয়ে ৯, আগস্টে ১১, সেপ্টেম্বরে ৩৪, অক্টোবরে ৮৬, নভেম্বরে ১১৩ এবং ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ পর্যন্ত মারা গেছেন ২৮১ জন। দিনের হিসাবে এক দিনে সর্বোচ্চ মারা গেছেন ১৩ অক্টোবর, এদিন মারা যান ৮ জন।
এ বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর— এই পাঁচ মাস ডেঙ্গুরোগীতে ভরে গিয়েছিল রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলো। বিশেষ করে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং শিশু হাসপাতালে প্রতিদিনই আসতে থাকে ডেঙ্গু-আক্রান্তরা। হাসপাতালে সিট না পেয়ে ফ্লোরে থেকেও চিকিৎসা নিয়েছেন অনেক ডেঙ্গু-আক্রান্ত রোগী।
এসব হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন যত ডেঙ্গু-আক্রান্ত মানুষ সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন, তার চেয়ে বেশি প্রতিদিন আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। ফলে দিন শেষে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিদিনই চাপ বেড়েছে হাসপাতালগুলোতে। হাসপাতালের শয্যার চেয়ে বেশি রোগী আসার কারণে পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
২০২২ সালে মহামারির মতো ডেঙ্গু-আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে অনুযায়ী ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ওই হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু হয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাসপাতালটিতে ডেঙ্গুরোগীদের জন্য চারটি ইউনিট চালু করা হয়। একই সঙ্গে ১২ জন চিকিৎসককে তিন শিফটে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রাকৃতিক নিয়মে ডেঙ্গু সংক্রমণ সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ধীরে ধীরে কমে যাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান বছরের চিত্র ছিল ভিন্ন। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে তো না-ই, বরং বেড়েছে দিনকে-দিন। যার রেশ দেখা গেছে নভেম্বর মাসে এসেও। কেবল নভেম্বর মাসেই ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৭৪ জন। কবে নাগাদ ডেঙ্গু সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় নামতে পারে—এমন প্রশ্নের সঠিক কোনও জবাব দিতে পারেননি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সিটি করপোরেশনের ভাষ্য মতে, সাধারণত সেপ্টেম্বরে কমার কথা থাকলেও সেটা বরং বেড়েছে। অক্টোবর ও নভেম্বরে আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, অসময়ে বৃষ্টিপাত, পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি অব্যাহত না রাখা, নাগরিকদের যথেষ্ট সচেতনতার অভাব; সিটি করপোরেশন নিয়মিত ওষুধ না ছিটানোসহ বিবিধ কারণে নভেম্বরেও ডেঙ্গু-আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে এসে কমতে শুরু করেছে ডেঙ্গু-আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে এ বছর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেটা স্বীকার করে হাসপাতালের পরিচালক জানান, ভর্তি রোগীদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন প্রায় শতভাগ রোগী। মুগদা হাসপাতালে কোনও ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু হয়নি বলেও জানান তিনি।
ডেঙ্গুরোগী ভর্তির হিসাবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, হাসপাতালটিতে মোট ভর্তি রোগীর মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এই হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু-আক্রান্ত ভর্তি রোগীদের মধ্যে ১৪টি শিশু মারা গেছে।
সব মিলিয়ে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ১৯টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে চলতি বছর সর্বমোট ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৩০৭ জন। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১০ হাজার ৪১ জন। আর এসব হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৩৬ জন।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে উঠে এসেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৪টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুতে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে- ৭, ৮, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ২৪, ৩৪, ৩৮, ৩৯, ৪১, ৪২, ৪৮ এবং ৫১ নং ওয়ার্ড।
অপরদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেগুলো হচ্ছে- ১, ১১, ১৪, ১৬, ১৯, ২০, ২১, ২৪, ২৮, ৩৩, ৩৪, ৩৫ এবং ৩৯ নং ওয়ার্ড।
ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানোর জন্য ডিএনসিসির পক্ষ থেকে বছরব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। যার মধ্যে ছিল— নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান, ওষুধ ছিটানো, নগরবাসীকে সচেতন করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণা। এ ছাড়াও, মোবাইল কোর্টের অভিযান এবং জরিমানা করা হয়েছে বলেও জানান মেয়র আতিক।
তবে কেবল জরিমানায় কাজ হবে না বলেও মনে করেন ডিএনসিসি মেয়র। তিনি বলেন, ডিএনসিসির কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। তার পাশাপাশি ডেঙ্গু থেকে বাঁচার জন্য, আক্রান্ত ও মৃত্যু কমানোর জন্য নগরবাসীকে সচেতন হয়ে নিজেদের বাসা-বাড়ি বা নতুন তৈরি ভবনের বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। নতুবা ডেঙ্গুর এই সংক্রমণ রোধ করা একা ডিএনসিসির পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
ঢাকা/এনএইচ