করোনা নিয়ে ইতালিয়ান চিকিৎসকের সতর্কবার্তা
মহামারি আকারে ছড়ানো করোনাভাইরাসের কেন্দ্রস্থল ইতালি এখন মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। সেখানকার এক চিকিৎসক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরেছেন। এ চিত্রকে ‘সুনামিতে সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া’র মতো পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
ইতালিয়ান ডা. দানিয়েল মাচিনি, কাজ করছেন দেশটির বার্গামো শহরের হিউম্যানিটাস গাওয়াজ্জেনি হাসপাতালে। যিনি অন্যান্য চিকিৎসকদের সঙ্গে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের দিন-রাত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
ইতালিতে মঙ্গলবার (১৭ মার্চ) পর্যন্ত ২১৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার। প্রতিদিনই হু-হু করে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। চীনের পরেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এবং মৃত্যুর ঘটনা ইতালিতেই ঘটেছে।
ডা. ড্যানিয়েল ম্যাচিনি তার ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাসে লিখেছেন, আমাদের দেশে (ইতালি) এখন ঘটে চলছে ভয়াবহ এক ট্র্যাজেডি। বৃদ্ধ রোগীরা মারা যাবার আগে চোখের পানি ফেলছেন। কাছের মানুষদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাবার সৌভাগ্যও তাদের নেই। তারা একা একা মরতে চাননি, কিন্তু তাদের বিদায় জানাতে হচ্ছে ক্যামেরাকে। তারা স্বজ্ঞানে, সমস্ত কষ্টকে সহ্য করতে করতে মরে যাচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী ও স্ত্রী একই দিনে মারা যাচ্ছেন। বৃদ্ধ দাদা-দাদি, নানা-নানীর তাদের নাতিদের মুখ শেষবারের মতো দেখতে পাচ্ছেন না। এই রোগ ফ্লু-র চাইতেও ভয়াবহ। বিশ্বাস করুন, ফ্লু'র চাইতে অনেক ভিন্নরকমের অসুখ এটি। এ রোগকে দয়া করে ফ্লু বলবেন না। জ্বর অসম্ভব বেশি। রোগীর দম এমনভাবে বন্ধ হয়ে আসতে চায় যেন সে ডুবে যাচ্ছে। রোগীরা হাসপাতালে আসতে চায়না। শুধু একটু অক্সিজেন পাবার জন্য তারা বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এই রোগের বিরুদ্ধে খুব সামান্য কিছু ওষুধ কাজ করে। আমরা সাহায্য করার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু সবকিছুই নির্ভর করছে রোগীর অবস্থার উপর। বৃদ্ধ রোগীরা এ রোগের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠছেন না।
আমরা কাঁদছি। আমাদের নার্সরা কাঁদছে। সবাইকে বাঁচিয়ে তোলার সামর্থ্য আমাদের নেই। চোখের সামনে মেশিনে তাদের জীবন থেমে যেতে দেখছি প্রতিদিন। প্রচুর রোগী আসছে। অতি দ্রুত আমাদের আরও বেড প্রয়োজন হবে। সবার একই সমস্যা। সাধারণ নিউমোনিয়া। প্রচণ্ড শক্তিশালী নিউমোনিয়া। আমাকে বলুন কোন ফ্লু এই ট্রাজেডির জন্ম দেয়?
এই ফ্লু অত্যন্ত সংক্রামক। এই ভাইরাসটি একেবারেই অন্যরকম। কোন কোন মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর। আমাদের দেশে ৬৫ বছরের বেশি বৃদ্ধদের প্রায় প্রত্যেকের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিংবা কোনো না কোনো রোগ রয়েছে। কোনো কোনো তরুণদের জন্যও এ রোগ ভয়ঙ্কর। এইসব তরুণ রোগীদের দেখলে কোনো তরুণই নিজেকে নিয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারবে না।
আমাদের হাসপাতালে কোনো সার্জারি আর হচ্ছেনা। বাচ্চাদের জন্ম, চোখের অপারেশন, কিংবা ত্বকের চিকিৎসা। সার্জারি রুমগুলো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আউসিইউ) রূপান্তর করা হয়েছে। সবাই যুদ্ধ করছি কোরোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে। প্রতি ঘণ্টায় রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। ক্রমাগত হাতে আসছে টেস্ট রেজাল্ট। সব পজিটিভ। পজিটিভ। পজিটিভ!
সব রোগীর একরকমের কমপ্লেইন:
অসম্ভব জ্বর।
শ্বাস কষ্ট।
কাশি।
ডুবে যাবার মত দমবন্ধ অনুভূতি।
প্রায় সবাই ইনটেনসিভ কেয়ারে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কেউ কেউ অক্সিজেন মাস্কের নিচেও শ্বাস নিতে পারছেন না। অক্সিজেন মেশিন এখন সোনার চাইতেও দামি।
বিশ্বাস করতে পারছিনা, কি দ্রুত এসব ঘটে গেল! আমরা সবাই ক্লান্ত। কিন্তু কেউ থামতে চাইছিনা। সবাই মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করে চলছি। ডাক্তাররা নার্সদের মত অবিরাম কাজ করে চলছেন। দুই সপ্তাহ ধরে আমি বাসায় যাই না। আমার পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের জন্য আমি শঙ্কিত। সন্তানদের সঙ্গে ক্যামেরা ব্যবহার করে কথা বলছি। মাঝে মাঝে আমি স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে কাঁদি। আমাদের কারো কোনো দোষ নেই। যারা আমাদের বলেছিল এই রোগটি তেমন ভয়ঙ্কর নয়, সমস্ত দোষ তাদের। তারা বলেছিল, এটি সাধারণ এক ধরনের ফ্লু। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর এখন অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে।
দয়া করে ঘরের বাইরে বের হবেন না। আমাদের কথা শুনুন। শুধুমাত্র ইমার্জেন্সি কারণ ছাড়া ঘর থেকে বের হবেন না।
সাধারণ মাস্ক ব্যবহার করুন। প্রফেশনাল মাস্কগুলো আমাদের ব্যবহার করতে দিন। মাস্কের অভাবে আমাদের স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মুখে। কোনো কোনো ডাক্তার এখন আক্রান্ত। তাদের পরিবারের অনেকেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাই নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করুন। বয়স্ক পরিবার পরিজনকে ঘরে থেকে বের হতে দেবেন না। আমাদের পেশার কারণে আমরা ঘরে থাকতে পারছিনা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা আমাদের রোগীদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা নিজেদের শরীরে অসুখ ও ভগ্নহৃদয় নিয়ে ঘরে ফিরছি। যাদের বাঁচাতে পারছিনা তাদের শরীরের কষ্ট কমানোর চেষ্টা করছি। কাল সব ঠিক হয়ে গেলে আমাদের কথা সবাই ভুলে যাবে। আমরা ডাক্তারদের এইটাই পেশা। তাই মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এই রোগ আপনাকে না ছুঁলেও সাবধানে থাকুন। জনসমাগম থেকে দূরে থাকুন। সিনেমায় যাবেন না, মিউজিয়ামে যাবেন না, খেলার মাঠে যাবেন না। দয়া করে বৃদ্ধ মানুষগুলোর দুঃখ অনুভব করার চেষ্টা করুন। তাদের জীবন আপনাদের হাতে এবং আপনারা আমাদের চাইতে বেশি মানুষের জীবন বাঁচাতে সক্ষম। আপনিই তাদের রক্ষা করতে পারেন।
সূত্র: নিউ ইয়র্ক পোস্ট
ঢাকা/এসএম
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন