ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪ ||  কার্তিক ২১ ১৪৩১

যখন থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সংঘাত শুরু

আন্তর্জাতিক ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ১৫ মে ২০২১   আপডেট: ০৮:১৪, ১৬ মে ২০২১
যখন থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সংঘাত শুরু

আধুনিক বিশ্বে বছরের পর বছর মানুষ হত্যা করে পার পেয়ে যাওয়া একমাত্র রাষ্ট্র হচ্ছে ইসরায়েল। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেলেও পশ্চিমা দুনিয়া ইসরায়েলকে সন্তানের মতোই লালন-পালন করছে। অথচ ১৯৪৭ সালের আগে ইহুদি রাষ্ট্রতো দূরের কথা ইসরায়েল নামে কোনো দেশই ছিল না পৃথিবীর বুকে। ইউরোপ থেকে জীবন বাঁচাতে নগ্নপায়ে আসা যেই ইহুদিদের ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় দিয়েছিল, তাদেরই বুকেই প্রায় প্রতিদিন গুলি চালাচ্ছে ইসরায়েল। কেন এই সংঘাত? এর উত্তর জানতে আমাদের একটু ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হবে।

ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, হজরত ইসহাকের (আ.) পুত্র হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর আরেক নাম ইসরাইল। তার নামানুসারে বংশধররা বনি ইসরাইল হিসেবে পরিচিত। বনি ইসরাইল পরবর্তীকালে নিজেদের ইহুদি নামে পরিচয় দিতে থাকে। হজরত ইয়াকুবের (আ.) এক পুত্রের নাম ছিল ইয়াহুদা। সেই নামের অংশবিশেষ থেকে ‘ইহুদি’ নামকরণ হয়। 

বনি ইসরাইলিদের প্রথম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত তালুতের সময়। পরে নবী ডেভিড বা দাউদ (আ) এই রাজত্ব বিস্তৃত করেন। দাউদের (আ.) পুত্র সুলাইমানের (আ.) সময় পর্যন্ত এই রাজত্ব টিকে ছিল। তার ছেলে রেহোবামের শাসন আমলে বনি ইসরাইলিদের রাষ্ট্র দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। উত্তরে ইসরায়েল দক্ষিণে জুদাহ। পরবর্তীতে ব্যবিলনীয় আক্রমণে ইহুদিদের নির্বাসিত হতে হয়। বাইবেলের আদি পুস্তক অনুযায়ী, মিসর থেকে সিনাই উপত্যকা হয়ে কেনানে ফিরে ইহুদিদের শান্তিতে বসবাসের জন্য ঈশ্বর নবী মুসাকে দুধ ও মধুর দেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের বিধান লঙ্ঘনের দায়ে ইহুদিদের তাদের সেই দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন ঈশ্বর। প্রথমবার ব্যলিনীয়দের এবং দ্বিতীয়বার রোমানদের হাতে বিতাড়িত হতে হয়েছিল তাদের। 

আরো পড়ুন:

মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে ইহুদিরা মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করেছে। স্পেনে উমাইয়া শাসনামালে তাদের মন্ত্রী হওয়ার নজিরও রয়েছে। এ কারণেই গ্রানাডা পতনের পর বিজয়ী রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা ইহুদিদের খ্রিষ্টান হওয়ার নয়তো দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেন। যেসব ইহুদি স্পেনে থেকে গিয়েছিল তাদেরকে ইনকুইজিশন হিসেবে পরিচিত চার্চের কঠোর নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়লেও শান্তিতে থাকতে পারেনি ইহুদিরা। আচরণগত কারণে তাদেরকে বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখা হতো। এছাড়া উনবিংশ শতাব্দিতে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটলে খ্রিষ্টানদের চরম নির্যাতনের মুখে পড়তে হয় তাদের। আজকে যেই ব্রিটেন ইসরায়েলিদের পরম মুরুব্বি, সেই ব্রিটেনের রাজারা ইহুদিদের ওপর গণহত্যা পর্যন্ত চালিয়েছিলেন।

উনবিংশ শতকের শুরুতে ইউরোপে নিপীড়নের শিকার ইহুদিদের মধ্যে জায়নবাদ আন্দোলন মাথাচাড়া দেয়। এই আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ১৮৮০ সালে নাকান বেরেনবুয়ান নামে এক অস্ট্রিয়ান ইহুদি জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। ১৮৯৬ সালে অস্ট্রিয়ান ইহুদি সাংবাদিক আনুষ্ঠানিকভাবে জায়নবাদ প্রকাশ করেন। তিনি দ্য জিউশ স্টেট গ্রন্থে জায়নবাদের রূপরেখা প্রণয়ন করেন এবং ইন্টারন্যাশনাল জায়নিস্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন। জায়নবাদীরা ইহুদি রাজ্য গড়ে তুলতে প্রথমে তুর্কি সুলতানের কাছে ফিলিস্তিন বিক্রির প্রস্তাব দেয়। সুলতান আব্দুল হামিদ তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে জায়নবাদিরা ভিন্ন কৌশলে হাঁটতে শুরু করে। তারা ধনী ইহুদিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বহিরাগত ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জমি কেনা শুরু করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে তুরস্ক থেকে গ্লিসারিন কিনতো ব্রিটিশরা। সমরাস্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই গ্লিসারিন। বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্ক গ্লিসারিন বানিজ্য বন্ধ করে দিলে বিপাকে পড়ে ব্রিটিশরা। ইহুদি বিজ্ঞানী ওয়াইজম্যান গ্লিসারিনের বিকল্প এসিটোন আবিস্কার করেন এবং এর ফর্মুলা ব্রিটিশদের কাছে তুলে দেন। ওয়াইজম্যান এর বিনিময়ে ব্রিটিদের কাছে ইহুদিদের জন্য আলাদা আবাসভূমির দাবি করেন। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর ব্রিটিশ ইহুদি নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে লেখা ৬৭ শব্দের চিঠিতে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন, যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের পর ফিলিস্তিনসহ আরবের বেশ কিছু অঞ্চল চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ার পর বিপুল সংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ৩৫ হাজারে পৌঁছে যায়। ১৯৩১ সালে ইহুদিদের এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায়। ১৯৪৮ সালে ইহুদিদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাহাজে করে যখন হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করলে আরবরা বুঝতে পারে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। শুরু হয় ইহুদি-আরব সংঘাত। আরবদের উৎখাতের জন্য ১৯১৮ সালে ব্রিটেনের সহযোগিতায় গঠন হয় ইহুদিদের গুপ্ত সংগঠন ‘হাগানাহ‘। পরবর্তীতে ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং নামে আরও দুটি জায়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে ওঠে। এরা ইউরোপ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ পায়। এই সংগঠনের সদস্যরা আরবদের বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার দখল করে তাদেরকে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়ন শুরু করে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। আরবদের ওপর ইহুদি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর হত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল তখন নিজেদের দিকে সহানুভূতি টানতে হাগানাহ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ১৯৪০ সালে এসএস প্যাটৃয়া নামক একটি জাহাজকে হাইফা বন্দরে তারা উড়িয়ে দিয়ে ২৭৬ জন ইহুদিকে হত্যা করে তারা৷ ১৯৪২ সালে আরেকটি জাহাজকে উড়িয়ে ৭৬৯ জন ইহুদিকে হত্যা করা হয়৷ 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিস্তিন ইস্যুটি চাপা পড়ে থাকে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আলাদা রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি আবারও সামনে আনতে ফিলিস্তিনে মোতায়েন ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর হামলা শুরু করে ইহুদি সশস্ত্র দলগুলো। এক পর্যায়ে ফিলিস্তিন ইস্যু সমাধানের জন্য ব্রিটেনের উপর চাপ বাড়তে থাকে। নিজের ওপর একতরফা দায় এড়াতে ব্রিটেন কৌশলে বিষয়টিকে জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দ্বি-রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ- একটি ইহুদিদের জন্য এবং অপরটি আরবদের জন্য। ইহুদিরা ১০ শতাংশ ভূখণ্ডের মালিক হলেও তাদের দেওয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। অথচ আরবদের জনসংখ্যা ও জমির মালিকানা ছিল দ্বিগুণ। 

জাতিসংঘের এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইহুদিরা জয় পাওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু হয়। এই সময় লাখ লাখ আরব বাধ্য হলো দেশ ত্যাগ করতে৷ আরব ও ইহুদিদের মধ্যে যখন দাঙ্গা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন ফিলিস্তিন ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় ব্রিটেন। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা দেন, ১৪ মে রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে। সেদিন রাত ১২টায় ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। পরদিন আরব দেশগুলোর ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায়। যুদ্ধে অসংগঠিত আরবরা পরাজিত হলে জর্ডান ও সিরিয়ার বড় অংশ দখল করে নেয় ইসরায়েল। 

আরব-ইসরায়েলের মধ্যে এরপর ফিলিস্তিন ইস্যুতে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে তিনটি যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধগুলোতে যথারীতি দুর্বল আরবদের পরাজয় ঘটেছে এবং শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। সেই দুর্ভোগের জের এখনও টানতে হচ্ছে নিজ ভূমিতে পরবাসী ফিলিস্তিনিদের।


 

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়