ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

গাজার অ্যাম্বুলেন্সে ইসরায়েলের হামলায় নিন্দার ঝড়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৮, ৪ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৫:১২, ৪ নভেম্বর ২০২৩
গাজার অ্যাম্বুলেন্সে ইসরায়েলের হামলায় নিন্দার ঝড়

ফিলিস্তিনের গাজায় অ্যাম্বুলেন্স বহরে শুক্রবার হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। এ ঘটনায় গাজাজুড়ে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় বইছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রথম হামলাটি হয়েছে গাজা সিটিতে। এতে অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও একজন স্বাস্থ্যকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন। অ্যাম্বুলেন্স বহরে পরের হামলাটি হয়েছে গাজা সিটির আল–শিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। সেখানে ১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। 

আল শিফা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অ্যাম্বুলেন্স বহরটি গুরুতর আহত রোগীদের নিয়ে মিশরের রাফাহ সীমান্তে যাচ্ছিল। 

ইসরায়েলের পক্ষ থেকে অ্যাম্বুলেন্সে হামলার দায় স্বীকার করে বলা হয়েছে, হামাসের সদস্যরা অ্যাম্বুলেন্সে যাতায়াত করছিলেন। তবে এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল–কুদরা।

তিনি বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সগুলো রওনা হওয়ার আগে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে রেড ক্রস, জাতিসংঘসহ সবাইকে জানিয়েছিলাম যে, গুরুতর আহত রোগীদের দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বহর মিশনের রাফাহ সীমান্তের পথে রওনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের সঙ্গে সমন্বয় এবং সামনে ও পেছনে এসকর্ট গাড়ি থাকা সত্ত্বেও অ্যাম্বুলেন্সে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।’

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরও বলেন, ‘রেড ক্রস অত্যন্ত খোলামেলাভাবে আমাদের জানিয়েছিল যে, ইসরায়েল সব ধরনের মানবিক মিশনের জন্য সমন্বয় প্রত্যাখ্যান করেছে। তবুও গুরুতর অসুস্থ রোগীদের মিশরে পাড়ি দেওয়ার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। বিকেল ৪টায় হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়া অনুমোদিত সেই অ্যাম্বুলেন্স বহরেই হামলা চালানো হয়েছে।’  

আল জাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেছেন, অ্যাম্বুলেন্সে হামলার বৈধতায় ইসরায়েল যা বলেছে, তা তাদের প্রমাণ করতে হবে। ইসরায়েলের এই হামলার অর্থ কী তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশারা। তিনি বলেন, ‘এর মানেটা কী, ইসরায়েল এখন প্রতিটি সম্ভাব্য অ্যাম্বুলেন্সে বোমাবর্ষণ করতে চলেছে কারণ তারা সন্দেহ করে যে এতে হামাস যোদ্ধারা আছে?’ তার মানে ইসরায়েলি বোমার লক্ষ্যবস্তু হতে চলেছে আরও আরও হাসপাতাল? আরও অ্যাম্বুলেন্স? আরও স্কুল? আরও গীর্জা?’

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অ্যাম্বুলেন্সে ইসরায়েলের এই হামলাকে ‘বেসামরিক ও আহত মানুষের বিরুদ্ধে একটি গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই গণহত্যা বন্ধ করা, যা আমাদের জনগণ, প্যারামেডিকস ও হতাহতদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আমাদের একটি মানবিক করিডোর তৈরি করতে সাহায্য করুন। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত ও রোগীদের পরিবহন নিশ্চিত করা যায় এবং মানবিক সাহায্য গাজা উপত্যকায় পৌঁছে দেওয়া যায়।’

কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক আরদি ইমসিস বলেছেন, ইসরায়েলকে তার দাবির পক্ষে ‘প্রমাণ’ দিতে হবে যে, অ্যাম্বুলেন্সগুলো হামাস সদস্যরা ব্যবহার করেছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা যা জানি…এই অ্যাম্বুলেন্স বহরটি খুব স্পষ্টভাবে বেসামরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাই লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা প্রাপ্য। বেসামরিক থেকে সামরিক চরিত্রে ইসরায়েল কথিত যে রূপ দিয়েছে, সেটি প্রমাণের দায়িত্ব আক্রমণকারী পক্ষের।’

আল-শিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গনে অ্যাম্বুলেন্সে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের ঘটনায় হতবাক হয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুস। সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে আবারও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা আবারও বলছি: রোগী, স্বাস্থ্যকর্মী, স্বাস্থ্যসেবা এবং অ্যাম্বুলেন্সকে সর্বদা সুরক্ষিত রাখতে হবে।’

কানাডার একজন ইমার্জেন্সি চিকিৎসক তারেক লুবানি, যিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আল-শিফা হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলি বাহিনী জানে যে, স্বাস্থ্যসেবার ওপর হামলাকে মানুষজন মেনে নেয় না। তারপরও ইসরায়েলি বাহিনী স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো ও হাসপাতালগুলোতে আক্রমণকে বৈধ করার চেষ্টা করছে।’

শুক্রবার হাসপাতাল প্রাঙ্গন ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর ইসরায়েলের এমন হামলা দেখে তিনি ‘খুবই আতঙ্কিত’ বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন। লুবানি বলেন, ‘কোনো স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা ও স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা মারা যাচ্ছে, প্যারামেডিকরা মারা যাচ্ছে, হাসপাতালগুলোতে একের পর এক বোমা হামলার ঘটনা ঘটছে।’ 

তিনি বলেন, ‘আমার দাবি এবং আমি মনে করি আমাদের সবার দাবি করা উচিত যে, ইসরায়েলিরা হাসপাতালের পবিত্রতা, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার পবিত্রতাকে যেন সম্মান করে, যাতে অন্য যাই ঘটুক না কেন, অন্তত একটি জায়গা নিরাপদ থাকে।’

ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (পিআরসিএস) মুখপাত্র মোহাম্মদ আবু মুসবাহ বলেছেন, আল-শিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে বোমা হামলার সময় সেখানে সাধারণ মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল। হাসপাতাল প্রাঙ্গনটি প্রায় ২০ হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষের আশ্রয়স্থল। 

আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক মুহাম্মদ আবু সিলমেয়েহ বলেছেন, হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসা সামগ্রী ফুরিয়ে গেছে, আরও বেশি সংখ্যক আহতদের আমরা চিকিৎসা দিতে পারছি না। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জ্বালানির অভাবে হাসপাতালের জেনারেটরগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। হাসপাতালের পিছনের ভবনটি হাজার হাজার রোগী ও ভুক্তভোগীদের বাসস্থান। সেখানে ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালের মর্গ লাশে ভর্তি। মৃতদেহগুলো ফ্রিজার ট্রাকে রাখতে হচ্ছে।’ 

আবু সিলমেয়েহ বলেন, ‘আমরা পুরো বিশ্বের কাছে এসওএস বার্তা পাঠাচ্ছি। এখানে অবশিষ্ট যা কিছু আছে তাও যদি ধ্বংস করতে চান তাহলে আমাদের খোলাখুলি বলুন। এই হাসপাতালের স্বাস্থ্যব্যবস্থা  ভেঙে পড়লে পুরো স্বাস্থ্য খাত ভেঙে পড়বে।’

আল-শিফা হাসপাতাল আইসিইউ, অপারেশন ও নবজাতক ইনকিউবেটর সেবায় গাজা উপত্যকার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। 

শুক্রবার উত্তর গাজার ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালের আশেপাশেও বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হাসপাতালটির মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক আতেফ আল-কাহলুত বলেন, ‘হাসপাতালের প্রধান জেনারেটর ৪৮ ঘণ্টা আগে বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা চিকিৎসাকর্মী সংকটে ভুগছি। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন করছি, শনিবার রাফাহ ক্রসিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় নির্ধারিত মেডিকেল বহরকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য।’

একের পর এক হাসপাতালে হামলার ঘটনা ঘটলেও হাসপাতাল খালি করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন গাজার আল-ওয়াফা হাসপাতালের পরিচালক হাসান খালাফ। তিনি জানিয়েছেন, তার হাসপাতালের আশেপাশেও অনেক বোমা হামলা হয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত কোনও ক্ষতি হয়নি। তবে তীব্র জ্বালাতি ঘাটতির কারণে হাসপাতাল পরিচালনা এবং রোগী ও কর্মীদের পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। 

খালাফ বলেন, ‘হাসপাতাল খালি করা অসম্ভব; যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, গাজায় কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। ইসরায়েল অনেক হাসপাতালে বোমাবর্ষণ করছে, তারা অ্যাম্বুলেন্সে বোমাবর্ষণ করছে, এমনকি তারা জাতিসংঘের পতাকাতলে শিশুদের স্কুলে বোমাবর্ষণ করছে। আমার পরিকল্পনা হল, ন্যূনতম যা কিছু আছে তা দিয়ে পরিষেবা চালিয়ে যাওয়া এই আশায় যে; স্বাস্থ্য খাতে জ্বালানি, চিকিৎসা সরবরাহ এবং আমাদের যা কিছু প্রয়োজন তা সরবরাহ করার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ থাকবে। কারণ আমরা এখন খুব সংকটজনক পরিস্থিতিতে পৌঁছেছি।’

হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ এক বিবৃতিতে গাজা উপত্যকায় অ্যাম্বুলেন্স এবং চিকিৎসা সুবিধার ওপর ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই গণহত্যার ঘটনা আমাদের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের লড়াইয়ের ফলে ইসরায়েলের করুণ পরিস্থিতির প্রতিফলন। প্রতিরোধ যোদ্ধারা আমাদের ভূমিকে রক্ষা করছে ও হাজার হাজার শহিদের প্রতিশোধ নিচ্ছে। প্রতিরোধ যোদ্ধারা সর্বশক্তি দিযে আমাদের জনগণকে রক্ষা করতে থাকবে।’ 

হানিয়েহ মিশরকে রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং সম্পূর্ণরূপে খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইসরায়েল ও তার মিত্রদের গণহত্যা কাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

ফিলিস্তিনিদের দাতব্য চিকিৎসা সহায়তার প্রধান মেলানি ওয়ার্ড এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘হাসপাতাল এবং অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। হাসপাতাল আহতদের ভরসাস্থল, যেখানে জীবন রক্ষা করা হয় এবং দুর্ভোগ লাঘব হয়। হাসপাতালগুলোকেও যদি সুরক্ষিত না করা হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থেই গাজার কোথাও কোনো নিরাপদ স্থান নেই।’

/ফিরোজ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়