ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৯ ১৪৩১

ইসরায়েল কি লেবাননের টেলিকম নেটওয়ার্ক হ্যাক করেছে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৪, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪  
ইসরায়েল কি লেবাননের টেলিকম নেটওয়ার্ক হ্যাক করেছে?

লেবাননে বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল সোমবার দিনভর লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রায় ১ হাজার ১০০টি লক্ষ্যবস্তুতে ব্যাপক বিমান হামলায় ৪৯২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও সহস্রাধিক মানুষ।

হামলা চালানোর আগে স্থানীয়দেরকে সতর্ক করে বার্তা পাঠিয়েছিল ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।

সোমবার ভোরে দক্ষিণ লেবানন এবং রাজধানী বৈরুতের আশেপাশের বাসিন্দারা একটি লেবাননের নম্বর থেকে এসএমএস এবং ফোন কল পেয়েছিলেন। হিজবুল্লাহ সক্রিয় রয়েছে, এমন এলাকা থেকে লেবাননের বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় এসএমএস ও ফোন কলের বার্তায়।

এ ঘটনা লেবাননে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা সৃষ্টি করে। এছাড়াও ইসরায়েল তার উত্তর প্রতিবেশীর টেলিকম নেটওয়ার্ক হ্যাক করেছে বলেও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসামরিক নাগরিকদের মোবাইল ফোন ও ল্যান্ডফোনে বার্তা পাঠানোর ঘটনাটি লেবাননের ওপর ইসরায়েলের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বেরও একটি রিমাইন্ডার।

ইসরায়েল যেভাবে সতর্কবার্তা দিয়েছিল

আল জাজিরার বৈরুত সংবাদদাতা মাজেন ইব্রাহিম জানিয়েছেন, কিছু মানুষ তাদের মোবাইল ফোনে বা ল্যান্ডফোনে রেকর্ড করা কল পেয়েছিলেন এবং কেউ কেউ পাঠ্য বার্তা পেয়েছিলেন। সব বার্তা একই ছিল।

আল জাজিরার দেখা একটি বার্তা- যেটি সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পাঠানো হয়- তাতে লেখা ছিল: ‘আপনি যদি হিজবুল্লাহ রয়েছে এমন একটি ভবনে থাকেন, তাহলে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ওই এলাকা থেকে দূরে থাকুন।’

সোমবার আল জাজিরার সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, বেসামরিক নাগরিকদের সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য রেডিও চ্যানেলগুলোও হ্যাক করা হয়েছিল।

সতর্কবার্তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লেবাননের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে বোমা হামলা শুরু হয়। এরপর সন্ধ্যায় রাজধানী বৈরুতেও বোমা হামলা চালায় ইসরায়েল।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি সোমবার ভোরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করা একটি ভিডিও বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা লেবাননের গ্রামের বাসিন্দাদেরকে (ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর) প্রকাশিত বার্তা ও সতর্কতার প্রতি মনোযোগ দিতে এবং তাদের নিজেদের প্রতি মনোযোগ দিতে আহ্বান জানাচ্ছি।’

আল জাজিরার বৈরুত সংবাদদাতা মাজেন ইব্রাহিম জানিয়েছেন, সোমবার যেসব এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরে যেতে বলা হয়; গত বছরের ৮ অক্টোবর ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকেই সেসব এলাকায় একের পর এক হামলার ঘটনায় ইতিমধ্যে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘তারা এমন সম্প্রদায় যারা ১১ মাসের যুদ্ধে ১ লাখেরও বেশি মানুষকে চলে যেতে দেখেছে। শুধুমাত্র কিছু মানুষ সেখানে রয়ে গেছে- যারা শুরু থেকেই এলাকা ছাড়তে রাজি ছিলেন না।’

লেবাননের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থার তথ্যানুসারে, রাজধানী বৈরুতে সোমবার যারা রেকর্ড করা কল পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে লেবাননের তথ্যমন্ত্রী জিয়াদ মাকারি ছিলেন।

আল জাজিরার বৈরুত সংবাদদাতা মাজেন ইব্রাহিমের মতে, ‘আমরা যা জানি না, তা হলো- ইসরায়েল কীভাবে লেবাননের বেসামরিক মানুষদের বিস্তারিত তথ্য পেযেছে- মোবাইল নম্বর, লোকেশন। …এটা কী ডেটা ফাঁসের কারণে নাকি ইসরায়েল লেবাননের টেলিকম অবকাঠামো হ্যাক করেছে?’

এগুলো কি সতর্কতার চেয়ে বেশি কিছু?

ইসরায়েল বলছে, বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি কমাতে বোমা হামলার আগে তাদের সেনাবাহিনী সতর্কবার্তা পাঠায়। গাজায় চলমান যুদ্ধের সময়েও দেশটিকে এই যুক্তি দিতে দেখা গেছে।  কিন্তু হামলাস্থলের ঘটনাগুলো ইসরায়েলের এই তত্ত্বকে সমর্থন করে না। অনেক ক্ষেত্রে, ইসরায়েলের বোমা এমন ভবনগুলোতে ফেলা হয়েছে যেগুলোর বাসিন্দারা কোনো সতর্কতা পায়নি৷ যেমন: গাজার পালিয়ে যাওয়া বেসামরিক নাগরিকদের উপর ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা হয়েছে।

হামলার আগে ইসরায়েলি সতর্কতা পাঠ্য বার্তা, ফোন কল বা ড্রপ করা লিফলেট আকারে আসতে পারে৷ কিন্তু গাজায় মোবাইলে সতর্কবার্তা দেওয়া প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বহু বছর থেকেই বলছেন, এটিও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের একটি উদাহরণ। ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি রিমাইন্ডার যে, ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী নিশ্চিতভাবে জানে- ফিলিস্তিনিরা কখন কোন এলাকায় রয়েছেন।

সুনির্দিষ্ট সতর্কতার জন্য ব্যবহৃত একই সরঞ্জামগুলো ইসরায়েলকে তার ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতেও সহায়তা করছে।

ইসরায়েলের হামলার যে প্যাটার্নের সঙ্গে গাজা পরিচিত, সোমবার সেটি লেবাননে প্রসারিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইসরায়েল কিভাবে লেবাননের টেলিকম নেটওয়ার্কে অনুপ্রবেশ করেছিল?

গত সপ্তাহে, লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত বলে ধারণা করা হাজার হাজার পেজার ও ওয়াকিটকি ডিভাইস বিস্ফোরণে অন্তত ৩৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। লেবানন সরকার, হিজবুল্লাহ এবং গোষ্ঠীর মিত্র ইরান এ ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। যদিও ইসরায়েল দায় স্বীকার করেনি, কিন্তু বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ বিস্ফোরণের ঘটনাটিকে পরিকল্পিত হামলা বলে মনে করছেন।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, ইসরায়েল ওই ডিভাইসগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটার কয়েক মাস আগেই বিস্ফোরক স্থাপন করেছিল।

লেবাননের নির্দিষ্ট অংশের ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে সতর্কবার্তা পাঠানোর ক্ষমতা থেকে বোঝা যায় যে, ইসরায়েলের কাছে লেবাননের বেসামরিক নাগরিকদের সম্পর্কে রিয়েল-টাইম তথ্যের অ্যাকসেস রয়েছে। লেবাননে শুধু হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের কথিত শত্রু নয়।

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বিশেষজ্ঞ এলিজাহ ম্যাগনিয়ার আল জাজিরাকে বলেছেন, ৮ অক্টোবরের আগেই ইসরায়েল লেবাননের টেলিকম নেটওয়ার্ক হ্যাক করেছিল।

তার মতে, ‘ইসরায়েলের কাছে ল্যান্ডফোন, গাড়ির প্লেট নম্বর, মোবাইল ফোনের অ্যাকসেস রয়েছে। এর ফলে তারা লেবাননের দক্ষিণে যে কারও সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়, ঠিক যেমনটি তারা পশ্চিম তীর বা গাজাতে করতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যার প্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা সরঞ্জামের অর্থ হলো, তাদের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ সঠিকভাবে ম্যাপিং করতে পারে- কে কোথায় অবস্থান করছে, তারা কী ফোন ব্যবহার করছে এবং কারা তাদের বাড়িতে ঘন ঘন আসে।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘ইসরায়েলের গোয়েন্দারা তাদের সরঞ্জাম নিয়ে কেবল রাস্তায় গাড়ি চালিয়েই বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার আইপি ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারে। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা যখন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফোনের সংগ্রহ শনাক্ত করে, তখন তারা উপসংহারে আসতে পারে যে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা রয়েছে-যেমন: হিজবুল্লাহর বৈঠক।

ইসরায়েল কি এর আগে এমন সতর্কতা জারি করেছে?

চলমান যুদ্ধের সময় ইসরায়েলকে এর আগে লেবাননের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের বোমা হামলা বিষয়ে সতর্ক করার জন্য বিমান থেকে লিফলেট ফেলতে দেখা গেছে।

কিন্তু অতীতেও দেশটির বিরুদ্ধে লেবাননের টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক হ্যাক করার অভিযোগ উঠেছে।

২০১৮ সালে, জাতিসংঘে লেবাননের স্থায়ী প্রতিনিধি আমাল মুদাল্লালি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মোবাইল লাইন হ্যাক করার এবং কাফর কিলা গ্রামের বেসামরিক মানুষদের কাছে রেকর্ড করা সতর্কবার্তা পাঠানোর জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। ওই বছর হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় আসন্ন হামলার সতর্কতা দেওয়া হয়েছিল।

ইসরায়েলের ‘শত্রুতাপূর্ণ’ আচরণের নিন্দা দাবি করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে একটি চিঠিতে মুদাল্লালি লিখেছিলেন, ‘এটি লেবাননের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও নিরাপত্তার ওপর একটি নতুন এবং অত্যন্ত গুরুতর আক্রমণ গঠন করেছে, যার মাধ্যমে ইসরায়েল ব্যক্তিদের মর্যাদা এবং গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে এবং তাদের জীবনের বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি তৈরি করছে।’

ইসরায়েল ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের নিরাপত্তা ভাঙার শক্তিশালী ক্ষমতার জন্যও পরিচিত।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ফরবিডেন স্টোরিজ এবং অনেক সংবাদ সংস্থার ২০২১ সালের তদন্ত অনুসারে, এ ধরনের একটি ম্যালওয়্যার হলো ‘পেগাসাস’। ইসরায়েলের সাইবার গোয়েন্দা কোম্পানি এনএসও গ্রুপের তৈরি করা এই ম্যালওয়্যারটি বিশ্বের একাধিক দেশ তাদের নাগরিকদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে ব্যবহার করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বিশেষজ্ঞ এলিজাহ ম্যাগনিয়ার মতে, লেবাননে অবৈধভাবে তথ্য সংগ্রহ সম্ভবত ২০০৭ সালে শুরু করে ইসরায়েল। ওই বছর দেশটির যোগাযোগ নেটওয়ার্কে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের নজরদারির তথ্য প্রথম জানা যায়। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে লেবানন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধের প্রেক্ষিতে মোসাদ এই পদক্ষেপ নিয়েছিল। সে বছর প্রথমবার হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় ইসরায়েল। এক মাসব্যাপী ওই যুদ্ধে লেবাননের ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং হিজবুল্লাহ যোদ্ধা নিহত হয়েছিলেন। অপরদিকে ইসরায়েলের প্রায় ১২০ জন সেনা সদস্য ও ৪০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। ওই যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয় অর্জন করতে পারেনি। তবে ইসরায়েলের বোমা বর্ষণে দক্ষিণ লেবাননে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল।

ইসরায়েলি শিক্ষাবিদ ওরি গোল্ডবার্গ নিউ লাইনস ম্যাগাজিনে এক নিবন্ধে বলেছেন, ইসরায়েল তার আঞ্চলিক শত্রুদের ওপর গোয়েন্দা শ্রেষ্ঠত্ব উপভোগ করে।

/ফিরোজ/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়