ভারতের একমাত্র ‘অহিন্দু প্রধানমন্ত্রী’
কলকাতা সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম
মনমোহন সিং যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান, তখনই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে যায় তার নাম। কারণ, স্বাধীন ভারতে তিনি-ই একমাত্র ও অদ্বিতীয় অহিন্দু প্রধানমন্ত্রী হন।
ড. মনমোহন সিংয়ের ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে ২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করেছিলেন দলটির সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। ২০০৯ সালেও সেই ভরাস রেখেছিলেন সোনিয়া।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রী না হলেও মনমোহন সিংয়ের নাম স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আগেই স্থান করে নিয়েছিল। ভারতের অর্থনীতির বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত মহাসন্ধিক্ষণের জন্ম হয়েছিল তার হাত ধরেই।
ভারতের উদার অর্থনৈতিক নীতির ‘জনক’ বলা হয় মনমোহন সিংকে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে নরসিংহ রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভারতের অর্থনীতির খোলনোলচে বদলে দিয়েছিলেন, অর্থনীতির উদারবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশটিতে।
মনমোহন সিংয়ের জন্ম তৎকালীন পশ্চিম পঞ্জাব প্রদেশের (বর্তমানে পাকিস্তানে) চকওয়াল জেলার গাহ গ্রামে। ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তার জন্ম হয় সেখানে। দেশভাগের সময় পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে কিশোর মনমোহন বাবা গুরমুখ সিং এবং মা অমৃত কৌরের হাত অমৃতসরে চলে আসেন।
চণ্ডীগড়ের পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে প্রথমে স্নাতক এবং ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন মনমোহন সিং। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম হন তিনি। ক্লাসে কখনো দ্বিতীয় হননি এই গুণী মানুষটি। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে চলে যান লন্ডনে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক, ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড কলেজ থেকে ডি-ফিল সম্পন্ন করেন মনমোহন সিং।
অক্সফোর্ডের পড়াশোনা শেষ করে মনমোহন ফিরে আসেন ভারতে। তারপর যোগ দেন জাতিসংঘের একটি চাকরিতে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত একটানা জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন শাখায় চাকরি করেন তিনি।
১৯৬৯ সালে মনমোহন শিক্ষকতা শুরু করেন। দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সে যোগ দেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধ্যাপক হিসেবে। কয়েক বছরের মধ্যেই অবশ্য সরকারি কাজের ভারও পড়ে তার ওপর। ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হন তিনি।
১৯৭৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থসচিব করা হয় মনমোহন সিংকে। ১৯৮০ সাল থেকে টানা দুই বছর যোজনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। তখন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখার্জি।
১৯৮২ সালে তার দায়িত্ব আরো বাড়ে। মনমোহনকে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর করা হয়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সেই পদে ছিলেন। এর পর দুই বছর (১৯৮৫-৮৭) যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৮৭ সালে অর্থনীতিবিষয়ক স্বাধীন সংস্থা সাউথ কমিশনের মহাসচিব পদে বসানো হয় মনমোহন সিংকে। এই কমিশনের যার সদর দপ্তর সুইত্জারল্যান্ডের রাজধানী জেনিভায়। সেখানেই ১৯৯০ সাল কাটে মনমোহনের। ১৯৯০ সালে আবার দেশে ফেরেন।
দেশে ফিরে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংয়ের অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান মনমোহন। ১৯৯১ সালের মার্চে ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান করা হয় তাকে।
১৯৯১ সালে এসে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা না হয়েও সরসারি সরকারের মন্ত্রী হয়ে যান মনমোহন সিং। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পিভি নরসিংহ রাও, যার এটিই ছিল প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্ব।
স্বাধীন ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি মনমোহন সিংয়ের অর্থমন্ত্রী হওয়া। তার হাত ধরেই শুরু হয় ভারতের অথর্নীতি ও বাজারনীতি।
১৯৯১ সালের আরেকটি ঘটনাও মনমোহন সিংয়ের নামের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত হয়ে আছে। কেন্দ্রেমন্ত্রী হওয়ার পর কংগ্রেসের হয়ে প্রথমবার রাজ্যসভা সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভারতের অর্থনীতি কাঁধে করে পার করেন মনমোহন। ১৯৯৯ সালে একবার লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যদিও হেরে যান তিনি।
২০০৪ সালে মনমোহনের জন্য আসে সবচেয়ে বড় চমক। ওই বছর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের জয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তখন সোনিয়া গান্ধীই ছিলেন প্রথম নাম। তবে তিনি খাঁটি ভারতীয় নন, বিদেশি- এই বিতর্কের সোনিয়ার আর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী পদে দ্বিতীয় নামটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সহায়তা করা প্রবণ মুখার্জির। গান্ধী পরিবারের বাইরে কংগ্রেসের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন তিনি।
তবে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে সোনিয়া গান্ধী সামনে আনেন মনমোহন সিংয়ের নাম। শেষপর্যন্ত জোট শরিকরাও মনমোহনের বিষয়ে সমর্থন দেয়। প্রধানমন্ত্রী হন অহিন্দু পাঞ্জাবি, যা ভারতের ইতিহাসে এক আজো এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ঢাকা/সুচরিতা/রাসেল