নতুন বছরে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরবে নাকি সংঘাত আরো বিস্তৃত হবে?
বিগত বছরের সংঘাতের জের ধরে ২০২৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত আরো বিস্তৃত হয়েছে। বছরের শেষ দিকে সংঘাতের পরিসর কমে এসেছে। তবে বিরাজমান পরিস্থিতিটি থমথমে। এটি নতুন বছরে সংঘাত ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত, নাকি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফেরার ইঙ্গিত সেই প্রশ্ন রেখে শেষ হচ্ছে ২০২৪ সাল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে লড়তে গিয়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে নৃশংসভাবে হত্যা করছে ইসরায়েলি বাহিনী। চলতি বছরের শেষ নাগাদ ৪৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, নিহতদের অধিকাংশই বেসামরিক এবং তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ নারী ও শিশু। ইসরায়েল চলতি বছরে হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ার, মোহাম্মদ দেইফ, সালেহ আল- আরৌরি, মারওয়ান ঈসাসহ অধিকাংশ শীর্ষ নেতাকে হত্যা করে। ইসরায়েলি হামলার ১৪টি মাস পশ্চিমারা একতরফাভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আহ্বান কানেই তোলেনি পশ্চিমা দেশগুলো এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা সংস্থা।
৭ অক্টোবর হামাসের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি সীমান্তে হামলা শুরু করে। ইসরায়েলেও পাল্টা হামলা চালিয়ে জবাব দিয়ে আসছিল। চলতি বছরের ২৭ জুলাই ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমিতে রকেট হামলায় ১২ শিশু ও কিশোর নিহত হওয়ার পর সংঘাত আরো তীব্র হয়। এই হামলার ঘটনায় হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে প্রতিশোধের অঙ্গীকার নেয় ইসরায়েল। ৩০ জুলাই ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর ঊর্ধ্বতন কমান্ডার ফুয়াদ শোকর নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে অগাস্টের শেষ দিকে ইসরায়েলে তিন শতাধিক রকেট ও ড্রোন দিয়ে হামলা চালায় হিজবুল্লাহ।
এ ঘটনার পর থেকেই হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ব্যাপক সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেয় ইসরায়েল। হিজবুল্লাহর সদস্যদের ব্যবহার করা পেজারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতসহ দেশটির বেশ শহরে একযোগে ঘটানো হয় এই বিস্ফোরণ। এতে এক শিশুসহ অন্তত ১২ জন নিহত এবং ২ হাজার ৭৫০ জন আহত হন। এর পরের দিনই, অর্থাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর হিজবুল্লাহর ব্যবহৃত ওয়াকিটকিগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে অন্তত ২০ জন নিহত এবং ৬০৮ জন আহত হন। এই হামলার মাধ্যমে হিজবুল্লাহর যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রায় পঙ্গু করে ফেলে ইসরায়েল
কয়েকদিন ধরে লেবাননের বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলের টানা হামলায় হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র কোরের নেতা ইব্রাহিম কুবাইসি, ড্রোন ইউনিটের নেতা মোহাম্মদ সরুর, ইব্রাহিম আকিল নিহত হন। ২৮ সেপ্টেম্বরের হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার দাবি করে ইসরায়েল। ২৩ অক্টোবর হাসান নাসরাল্লাহ উত্তরসূরি হিসাবে বিবেচিত হাসেম সাইফ উদ্দিন ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত হন। প্রায় দুই মাস তীব্র যুদ্ধ চলার পর ২৬ নভেম্বর ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও লেবানন একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ২৭ নভেম্বর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রক্সি গ্রুপ হিজবুল্লাহর ওপর হামলার পর নীরব থাকেনি ইরান। ইসরায়েলও ইরানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে বোমা হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর দুই ব্রিগেডিয়ারসহ ১৬ কর্মকর্তা নিহত হন। এই হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে এর প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দেয় ইরান। ১৩ এপ্রিল মধ্যরাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরান প্রায় ১৭০টি ড্রোন, ৩০টিরও বেশি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ১২০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাায়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী অবশ্য তাদের উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা দিয়ে অধিংকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ধ্বংস করে ফেলে। এটি ছিল ইসরায়েলের ওপর ইরানের প্রথম সরাসরি হামলা। এর প্রতিশোধ নিতে ১৯ এপ্রিল ইরানে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। ইরানের দাবি, তারা হামলা প্রতিহত করেছে এবং এতে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
৩১ জুলাই ইরানের রাজধানী তেহরানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়া ইসরায়েলের হামলায় নিহত হন। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইসরায়েলে সরাসরি হামলার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে ১ অক্টোবর ইসরায়েলে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইরানের প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চল কেঁপে উঠে।
অবশ্য ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছিল, ইরানি হামলায় তাদের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ইসরায়েলের এই দাবির সত্যতা আজো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এই হামলার প্রতিশোধ নিতে ২৬ অক্টোবর ইরানের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে ইসরায়েল। ৩১ অক্টোবর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি তার সামরিক কর্মকর্তাদের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক হামলার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। ইরানি কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়া ‘কঠোর’ এবং ‘অকল্পনীয়’ হবে। অবশ্য ইরানের সেই ‘অকল্পনীয়’ পাল্টা হামলা এখনো পর্যন্ত হয়নি।
গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে বারবারই ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এসব হামলা চালানো হচ্ছে বলে দাবি করে আসছে হুতিরা। জুলাই মাসে প্রথমবার তেল আবিবে ড্রোন হামলা চালায় হুতিরা। ওই হামলায় এক ব্যক্তি নিহত হন। আহত হন চারজন। এর জবাবে ইয়েমেনের হোদেইদাহ বন্দরের কাছে হুতি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ছয়জন নিহত হন। আহত হন ৮০ জন। ২১ ডিসেম্বর ইসরায়েলের তেল আবিবের জাফা এলাকায় ‘ফিলিস্তিন-২’ নামক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় হুতি বিদ্রোহীরা। এতে অন্তত ২০ জন আহত হয়। এর পরের দিনই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইয়েমেনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়ানোর হুমকি দিয়েছেন।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ শান্তির বাতাস আসে সিরিয়া থেকে। বিদ্রোহীদের প্রবল আক্রমণের মুখে মাত্রা ১২ দিনের মধ্যে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন ঘটে। এর মাধ্যমে দেশটিতে বাশার পরিবারের অর্ধ শতাব্দির রাজত্বের অবসান ঘটে। বিদ্রোহীরা যখন আসাদের পতন ঘটিয়ে উল্লাস করছিল, তখন ইসরায়েল সিরিয়ার বেশ কয়েকটি অঞ্চল দখল করে ফেলে এবং দেশটির নৌ সামরিক শক্তিকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলে।
বাশার আল আসাদের পতনের পরপর পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা সিরিয়ায় দৌঁড়ঝাপ শুরু করে দিয়েছেন। তারা দেশটির নতুন সরকারকে সব ধরনের সহায়তার জন্য প্রস্তুত। এর বড় একটি কারণ হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইরান ও রাশিয়ার প্রভাবকে দূর করা।
সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব একরকম শেষ হয়ে গেছে। লেবাননে ইরানের শক্তিশালী প্রক্সি গ্রুপ হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা বেশ কমেছে। তবে ইয়েমেন এবং ইরাকে এখনো ইরানের যথেষ্ট প্রভাব রয়ে গেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি তেহরানের বাহিনীকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছেন। আর ইসরায়েল পশ্চিমাদের সমর্থন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তার আগ্রাসী থাবা বিস্তারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিরাজমান এই পরিস্থিতি যে নতুন বছরে আরেকটি সংঘাতের বার্তা দিতে যাচ্ছে তা হয়তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঢাকা/শাহেদ