ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘যে গান মানুষ মনে মনে গায় না, সেই গান চিরদিনের নয়’

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪৪, ২২ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘যে গান মানুষ মনে মনে গায় না, সেই গান চিরদিনের নয়’

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

‘খোকা ফিরবে নাকি ফিরবে না’, ‘ভালোবাসা যতো বড় জীবন ততো বড় নয়’, ‘দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘মাঠের সবুজ থেকে সূর্যের লাল’সহ বহু শ্রোতাপ্রিয় গানের গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। তার প্রকাশিত গানের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। গানের পাশাপাশি প্রায় একশ সিনেমার কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন। এছাড়া মঞ্চ, বেতার ও টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখেছেন এবং অভিনয়ও করেছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৪টি। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৪ সালে ‘চন্দ্রনাথ’ ও ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ সিনেমার জন্য সেরা গীতিকার এবং ২০০৮ সালে ‘মেঘের কোলে রোদ’ সিনেমার জন্য সেরা কাহিনিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। গতকাল ছিল বিশ্ব সংগীত দিবস। স্বনামধন্য এই সংগীত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলেছেন রাহাত সাইফুল। তাদের কথোপকথনের চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

রাহাত সাইফুল : কোন পথে যাচ্ছে বাংলা গান?
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয়া কঠিন। বাংলা গান পথভ্রষ্ট হওয়ার দিকেই যাচ্ছিল। এখনকার তরুণদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি মূল ধারার বাংলা গানের প্রতি তাদের আকর্ষণ প্রচণ্ড- এজন্য আমি পুনরায় আশাবাদী হয়ে উঠেছি। আমাদের  মেজাজ আলাদা, আমাদের মাটির ধরন আলাদা। মাটির ধরনই আমাদের মেজাজ তৈরি- এটা বুঝে গান করতে হবে। এখন যারা গান করছেন তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরন আছে। কোনো ধরনই আমি বাতিল করছি না। তবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার আগে তারা যেন ভুলে না যায়- শিকড় যেন বাংলাদেশের মাটিতে থাকে। শিকড় যদি ইউরোপে চলে যায় বা অন্য কোথাও চলে যায়, সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হবে- এই দেশ ভাসমান হয়ে যাবে। দেশের নিজস্ব কোনো কিছু থাকবে না। ভালো গান তৈরি করে এটা রোধ করতে হবে।

রাহাত সাইফুল : সংগীতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা কী বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : আমরা সংগীতের সোনার মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলেছি। নতুন মানুষ তৈরি হচ্ছে না। যারা কবিতা বুঝে গানের সুর করতেন তাদের অনেকেই আজ নেই। নেই সমর দাস, সুবল দাস, সত্য সাহা, খন্দকার নুরুল আলম। জুনিয়রদের মধ্যে আলাউদ্দিন আলী আছেন।  তিনিও অসুস্থ। আহম্মেদ ইমতিয়াজ বুলবুল চলে গেল। এরা কথা বুঝে সুর করতেন। যেমন আমি মাকে নিয়ে গানটা করলাম- ‘সেই রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার পাশে দাঁড়িয়ে এক মধ্যবয়সী নারী এখনও রয়েছে হাত বাড়িয়ে’- এই গানের গল্প শুনে বুলবুল কেঁদে ফেললো। সে ভিতর থেকে ফিল করেছে বলেই কেঁদেছে। ফিল করার মানুষ এখন কমে যাচ্ছে।  এমন মানুষ তৈরি না হলে সংগীতের জন্য ভয়াবহ খারাপ অবস্থা হবে।  দেখা যাবে তখন মুম্বাইয়ের গান নকল করছে।  তাতে নিজস্বতা হারিয়ে যাবে। এই জায়গা থেকে বাংলা গান ঝুঁকিতে আছে। এখন স্টুডিও ঘরে ঘরে হওয়ায় নিজের মতো করে যা ইচ্ছে তাই করছে অনেকে। কেউ কেউ নিজে লিখে সুর করে গেয়েও ফেলছে।

রাহাত সাইফুল : ‘রেল লাইনের ধারে’ গানটির পেছনের গল্প জানতে চাই। এটি বিখ্যাত একটি গান।
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : আমার ছোট ভাই আসাদ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়।  মা জানতেন না- ও শহীদ হয়েছে।  আমাদের বাড়ির পুকুর পাড়ের পাশ দিয়ে রেল লাইন। যুদ্ধে যাওয়ার আগে ও মাকে বলে গিয়েছিল। এই রেল লাইনের পাশে ছোট একটি রাস্তা আছে। সেই রাস্তা ধরে আসাদ চলে গিয়েছিল। মা প্রায়ই একথা বলতেন। ঐ মধ্যবয়সী নারী আমার মা। আর খোকা হচ্ছে আমার ছোট ভাই।  আমার অনেক গানেই এমন ঘটনা আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ছায়াছবির গান খুব কম লিখেছি। কারণ কোথাও সিকোয়েন্স পছন্দ হয়নি, আবার কখনও গল্প পছন্দ হয়নি।

রাহাত সাইফুল : ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’ গানটিও আপনার লেখা। এটিও দারুণভাবে শ্রোতাপ্রিয় একটি গান।
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : সত্য সাহা একদিন বাসায় এসে আমার স্ত্রীকে বললেন— ভাবি আজ দুপুরে আপনাদের বাসায় খাব। সেদিন সুবীর নন্দীকে আমার বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। আমাকে বললেন, দুটি গান লিখতে হবে। সাবিনা ইয়াসমিনের জন্য একটা, আর নতুন এই ছেলেটার জন্য একটা। তখন সুবীর নন্দীর জন্য প্রথমে লিখলাম, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’। সেদিনই বসে অর্ধেক লিখে ফেলি। সত্য সাহা টান দিয়ে সেই অর্ধেক নিয়ে গেলেন। বললেন- বাকি অর্ধেক পরে নেব। গান লেখা শেষ হলে সুর দিলেন সত্য সাহা। আমরা এই গানটি রিলিজ না করে পরিকল্পনা করলাম, একজন শিল্পীর তিনটি গান একসঙ্গে রিলিজ দেব। এর মধ্যে থেকে অন্তত একটি গান হিট হবে। এরপর ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘বধুয়া মান ভাঙাতে জীবন’ শিরোনামে দুটি গান লিখলাম। দুটি গানেরই সুর করলেন খন্দকার নূরুল আলম। এই তিনটি গান একসঙ্গে রিলিজ দেয়ার পর তিনটি গানই হিট হয়ে গেল। এরপর সুবীর নন্দীকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

রাহাত সাইফুল : এখনকার লিরিকের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে?
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : লিরিকের ক্ষেত্রে একটা ইয়াং গ্রুপকে দেখছি ভালো কাজের ক্ষেত্রে মনোযোগী। আর একটা গ্রুপকে দেখছি তারা কোনো কোনো সুরকারের পিছনে ঘুরে বা গায়কের পিছনে ঘুরে কোনো রকম নাম করে গেছে। পুরস্কারও পেয়ে গেছে! শুদ্ধ করে লেখার মতো গুণাবলী তাদের মধ্যে নেই। আর সেটা না থাকার কারণে হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া এবং হঠাৎ করেই নিভে যাওয়া। কিন্তু যারা শুদ্ধ পথের অনুসারী তারা হারাবে না।

রাহাত সাইফুল : এ কারণেই কি এখন কিছু গান আলোচিত হয়ে কিছুদিন পরেই হারিয়ে যাচ্ছে?
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : একটা কথা মনে রাখতে হবে, যে গান মানুষ মনে মনে গায় না, সেই গান চিরদিনের গান নয়। কারণ সেটা হৃদয় স্পর্শ করেনি। এই গানগুলো কানে থাকছে, প্রাণে থাকছে না। প্রাণকে আকুল করছে না বলেই হারিয়ে যায়।

রাহাত সাইফুল : এখনকার অধিকাংশ গানে যন্ত্রের ব্যবহার অনেক বেশি।  যে কারণে শিল্পীর আসল কণ্ঠ বোঝা যায় না। এটা গানের জন্য কতটা ক্ষতিকর?
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : এটা হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ বিষয়। আমি কি শুনছি? গান শুনছি। সেখানে যদি যন্ত্র শুনি তাহলে যন্ত্রসংগীত শুনলেই তো হলো। লোকে আমাকে বলে- গান লিখি। আমি কখনও বলি না- গান লিখি। আমি বলি- আমি কবিতা লিখি। এমন কবিতা লিখি যেটা সুরের জন্য অপেক্ষা করে। সেই কবিতা নিয়েই গান হয়। সংগীতে অকারণ যন্ত্র ব্যবহার ক্ষতিকর। যন্ত্রের কাজ হচ্ছে সংগীতের আবহ তৈরি করা। আর সেটা যদি গানকেই ঢেকে দেয়, সেটা আর যাই হোক গান নয়- বাজনা।

রাহাত সাইফুল : চলচ্চিত্রের গান একটা সময় মানুষের মুখে মুখে থাকতো। এখন সে রকমন গান হচ্ছে না কেন বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : প্রধান কারণ হচ্ছে- চলচ্চিত্র হচ্ছে না। আমরা একটা সময় ‘ডবল টিকেট’ আর ‘রিটার্ন টিকেট’ সিনেমা বলতাম। ডবল টিকেট হচ্ছে যে সিনেমা দেখতে পরিবার নিয়ে যেতে হবে। আর রিটার্ন টিকেটের সিনেমা হচ্ছে, যে সিনেমা একবার দেখে আবার দেখতে হবে। এখন আর এসব হয় না। সিনেমার গান তখনই হিট হয় যখন সেটা ছবির অংশ হয় ওঠে। সিনেমার অংশ না হলে গান হিট হয় না। কারণ ছাড়া সিনেমায় গান ব্যবহারের ফলে গান হিট হচ্ছে না।  গানের সিচুয়েশন তৈরি করে গান ব্যবহার করতে হবে।

রাহাত সাইফুল : চলচ্চিত্রে আইটেম গানের ব্যবহার হচ্ছে। এসব গানে অশালীন শব্দ ও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান :  অশালীন শব্দ কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর! ইংরেজি শব্দ অকারণে করলে হবে না। আমরা এক সময় ফোক সংগীতেও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে দেখেছি।  প্রচলিত ইংরেজি ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এই ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ঠিক ওখানে বসে না। একবার কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ নিয়ে একটি গান লিখেছিলাম। ‘রিটার্ন টিকেট হাতে লইয়া আইসাছি এই দুনিয়ায়, টাইম হইলে যাইতে হবে যাওয়া ছাড়া নাই উপায়’। এখানে রিটার্ন টিকেট, টাইম এগুলো বলতে বলতে মানুষ অভ্যস্ত। ঐ সময় আমি আর একটা গান লিখি: ‘তুমি থাক ঢাকা, আমি থাকি জিঞ্জিরায়, কেমনে তোমার প্রেমের পঙ্খি পুইষা রাখি পিঞ্জিরায়’। বললাম- এই গানটার অর্থ কী?  উত্তর দিলো- এটার অর্থ হচ্ছে তুমি ঢাকায় থাকো, আর আমি নদীর ওপাড় জিঞ্জিরায় থাকি। আমি বললাম- না। এই কথার গভীর অর্থ আছে। ঢাকা থাকা মানে তোমাকে দেখা যাচ্ছে না। আল্লাহকে দেখা যায় না। আর আমি কোথায় থাকি? আমি অনেক নিয়ম কানুনের জিঞ্জিরায় আবদ্ধ থাকি। ফলে প্রেমের পঙ্খিকে কী করে পিঞ্জিরায় আবদ্ধ রাখবো? যাই লিখি না কেন এর অর্থ ও কারণ থাকতে হবে।

রাহাত সাইফুল : গীতিকার হতে হলে কী গুণাবলী থাকতে হবে বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : গীতিকার বলে কোনো শব্দ নেই- কবি। তাকে প্রথম কবি হতে হবে। কাব্য কী জানতে হবে। ফিল করতে হবে। কবি বানানো যায় না। এই ফিলটা এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে কম। তাদের অর্ডার করছেন আর লিখছেন। কবিতায় কথা আসে, জোড় করে বানানো যায় না। কবি প্রতিভা থাকলে তাতে শান দেয়া যেতে পারে।

রাহাত সাইফুল : বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের কার গান শোনেন?
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : সবার গান শুনি। এর মধ্যে সাব্বির, ইউসুফ, ঐশীসহ অনেকের গান শুনি। ঐশীর একটা ডিফারেন্ট প্যাটার্ন আছে। এটাকে আমি খারাপ বলছি না। ওকে যদি ভালো গাইড করা যেত ও আরো ভালো করতো।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ জুন ২০১৯/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়