সংস্কৃতি মরে না, রূপান্তরিত হয়ে সামনের দিকে যায় : যতীন সরকার
শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম
ঋতু বৈচিত্র্যময় বাংলার বিকাশ, বিস্তার, এর অন্তর্নিহিত ভুবন, এর ছড়িয়ে পরা আলো, প্রতিবন্ধকতা, রাজনীতিকরণ, প্রতিস্রোতের মধ্যেও বলিষ্ঠ অভিযাত্রা, এর মানবিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রসরতা এবং সর্বোপরী আবহমান বাংলা ও তার জনপদ সম্পর্কে বাঙালির চিন্তক, সংস্কৃতির প্রতিভু অধ্যাপক যতীন সরকারের ভাবনা এই সাক্ষাৎকারের উপজীব্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও ফোকলোর গবেষক শিহাব শাহরিয়ার। তাদের কথপোকথন রইলো রাইজিংবিডির ঈদ সংখ্যায়।
শিহাব শাহরিয়ার: একজন বাঙালি হিসেবে বাংলার জীবিকাজীবীদের ঋতুভিত্তিক উৎসব সম্পর্কে আপনার অনুভূতি ও মন্তব্য জানতে চাই।
যতীন সরকার: কৃষিজীবীদের মধ্যেই মূলত উৎসবের সূত্রপাত এবং নগরের যে মানুষ, তারা তো মূলত, অন্তত আমাদের দেশে অধিকাংশই কৃষিভিত্তিক গ্রামসমাজ থেকে আগত। গ্রামের সঙ্গে আমাদের শহরে বা নগরে আমরা যারা বাস করি, সেই মানুষের সঙ্গে তাদের যে একটা সম্পর্ক ও যোগাযোগ বিদ্যমান, সেটা আমরা ঈদ বা পূজা এ সমস্ত উৎসবগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করি। সব মানুষ নগর থেকে গ্রামে ছোটে শিকড়ের সন্ধানে। কাজেই শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্তি আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে এখনও প্রচণ্ডভাবে বিদ্যমান।
মূলত গ্রামে যে উৎসব হয়, সেগুলো ঐ শহরের যে উৎসবের চেহারা সেটা ধরে না। গ্রামের উৎসব স্বাভাবিকভাবে গ্রামের মানুষ পালন করে, সেটা উৎসব হিসেবে ধরে না- এটা জীবনের অংশ হিসেবে নেয়। যেমন নববর্ষ। বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এলেই গ্রামাঞ্চলে আমরা দেখেছি- বাঙালি ঘরে ঘরে নতুন কিছু খাওয়ার ধুম পড়ে যায়! পহেলা বৈশাখ যদি ভালো খাওয়া যায়, তাহলে সারা বছর ভালো খাবার মিলবেই। কাজেই অত্যন্ত দরিদ্র মানুষও চেষ্টা করে একটু ভালো খাবারের। নববর্ষে গ্রামের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সালাম, প্রণাম বা বুকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করে- এটা আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি। এবং সবাইকে আশীর্বাদ ও শুভ কামনা জানায় যে- বছর তোমার ভালো যাক। এটা হচ্ছে গ্রামের। এখন সেই গ্রাম থেকে শহরে একটু প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে। শহরে-বন্দরে উৎসব পালন করা হয় এবং বিশেষ করে ঐ পাকিস্তান আমলের শেষ দিক থেকে এই উৎসবগুলো শহর-বন্দরে বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। জমজমাট হয়ে ওঠার বড় কারণ হচ্ছে এই যে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এবং পাকিস্তানি ভাবধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ এ সমস্ত উৎসব পছন্দ করতো না। তারা বলত, এগুলো হিন্দুয়ানী এবং এগুলো ভারত থেকে আমদানি করা এবং ভারতের নানা রকম ষড়যন্ত্র এগুলোর মধ্যে বিদ্যমান।
আমার মনে আছে. ময়মনসিংহ শহরে আমি তখন থাকি। তখন মুকুল ফৌজের পরিচালিত একটি স্কুল মুকুল নিকেতনে নববর্ষ উপলক্ষ্যে একটি অনুষ্ঠান সন্ধ্যায় আয়োজন করেছিল এবং সেখানে আমাকে একজন বক্তা হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি নববর্ষের উৎসব সম্পর্কে আমার প্রাণ উজার করে যা যা বলা উচিত সবই বললাম। এই যে বাঙালির নববর্ষ, এটি আমাদের প্রাণের উৎসব। এই উৎসব কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না। বন্ধ করার যে পায়তারা করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তো উৎসবের সভাপতির আসন গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন একজন এডিসি অর্থাৎ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। তিনি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আবার কানেও কম শুনতেন। কিন্তু আমার এই প্রাণের কথাটা তার কানের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে মর্ম যাতনা দিলো এবং তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তিনি তার বক্তৃতায় বলতে লাগলেন, আমি ভেবে পাই না যে আমরা কোথায় আছি? আমরা কি পশ্চিম বাংলার কোনো জায়গায় আছি না পূর্ব পাকিস্তানে আছি? এখানে বাঙালি বলে কোনো জাতি নেই! এই বাঙালি আসলো কেন? এই যে বাঙালির কথা, বাঙালির উৎসব, এটাই আসলে পাকিস্তান-বিরোধিতার একটা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। কাজেই এ সমস্ত যারা করে তাদের সম্পর্কে আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
আমার নাম অবশ্যই বলা হয়নি কিন্তু সকলেই ধরে নিলো আমার বিরুদ্ধেই বলা হচ্ছে। কারণ আমি এই বাঙালি উৎসবের কথা বলছি এবং তারপরে দেখা গেল আমাদের কলেজে এই ভদ্রলোক এডিসি সাহেব আমাদের প্রিন্সিপালকে বললেন, আপনার কলেজে এরকম একজন মাস্টার আছে, তিনি ছাত্রদের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী চিন্তা-চেতনার বিস্তার ঘটাচ্ছেন। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কথাটা আমাকে আমার প্রিন্সিপালই জানিয়েছিলেন।
এই যে ব্যাপারগুলো এগুলো পাকিস্তান আমালে ঘটে গেছে এবং এতো বেশি পরিমাণে ঘটেছে, আমরা কিন্তু তার বিরুদ্ধে তত বেশি পরিমাণে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছি। এই প্রতিরোধের মধ্য থেকেই পাকিস্তান আমলেই দেখা গেছে ঐ নববর্ষ উৎসবে শহরে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। গ্রামে যেমন হতো না, এটার একটা রূপান্তর ঘটে গেল শহরে। এখানে, যেমন আমরা মুকুল ফৌজ থেকে একটা বিরাট শোভাযাত্রা বের করতাম। শোভাযাত্রা করে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গিয়ে থামতাম এবং এখানে নববর্ষ উপলক্ষ্যে মেলা আলোচনা হতো এবং খই-মুড়ি ইত্যাদি সেখানে খাওয়া হতো। এই যে পাকিস্তান আমলেই আমাদের এই অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল তা পাকিস্তানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া থেকেই।
আগেই বলেছি, গ্রামের মানুষেরা এগুলোকে উৎসব মনে করত না। তারা মনে করতো এসব রীতি। এগুলো আমাদের করতে হবে। নববর্ষের দিন আমাদের ভালো খেতে হবে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হবে। যেহেতু পাকিস্তান আমলে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলো। রবীন্দ্রনাথের সংগীত নিষিদ্ধ হলো। আর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলাম, এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবেই ঐ নববর্ষের উৎসব সমস্ত নগরে-বন্দরে নতুনভাবে অর্থাৎ নতুন আঙ্গিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিশেষ গতিবেগ পায়। এই গতিবেগ আমরা রাজনীতিতেও নতুন ধারার সূচনা হতে দেখি। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপান্তরটা ঘটিয়েছে। আমাদের ছয় দফা থেকে আস্তে আস্তে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে, স্বাধীনতা আন্দোলন- যে আন্দোলনের মূলে ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করেছে পাকিস্তানিরা। কাজেই সেই সময় আমরা যদি সাংস্কৃতিক আন্দোলন না করতাম, উৎসবগুলোকে নগরভিত্তিক রূপান্তরিত করে না নিতাম, তাহলে নতুন রাজনীতিও এভাবে গড়ে উঠতে পারত না বলে আমি মনে করি।
শিহাব শাহরিয়ার: নগরে উৎসবগুলোর আয়োজন কারা করে? তারা কি গ্রামতাড়িত নস্টালজিক মানুষ?
যতীন সরকার: নগরে যে উৎসবগুলোর আয়োজন হয়, তাতে কোনো নস্টালজিক বিষয় থাকে না। আসলে মূলত আমাদের যে নগরের মানুষ, গ্রামের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক তা এখনো পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নি। আমাদের এখানে নগর তো অল্প দিনের। ফলে উভয় জায়গার মানুষের সম্পর্ক এখনো গভীরভাবে বিদ্যমান। কাজেই গ্রাম এবং নগরকে আলাদা করা যায় না। তবে গ্রামে যেভাবে উৎসব পালিত হতো, তা নগরে এসে রূপান্তরিত হয়েছে। নগরের শিক্ষিত লোকেরা, যারা বিশেষ করে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা করে, আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে চায়, তারাই উৎসবগুলোকে নতুন রূপ দান করেছে। বিভিন্ন পেশার মানুষ যারা প্রগতিশীল, তারাই নগরে নববর্ষ, নবান্ন, হেমন্ত, বসন্ত ইত্যাদি উৎসবের আয়োজন করে। একটা মজার ব্যাপার, এই উৎসবগুলো পালনে যত বিরোধিতা আসে, উৎসবগুলো আরো নতুন রূপ ধারণ করে। আমরা তো দেখেছি, বিরোধিতার মধ্য দিয়েই আমাদের সমস্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু হয়েছে।
আমি তো বলি, জিন্নাহ সাহেব যদি ১৯৪৮ সালে না বলতেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’, তাহলে পাকিস্তান ভাঙার সূচনা এভাবে ঘটত না। তার বলার মধ্য দিয়েই পাকিস্তান ভেঙে গেছে এবং এই যে ভাষা আন্দোলন সেটা আসলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোর মূল। কারণ ভাষা দিয়েই প্রকৃত প্রস্তাবে একটি জাতি নির্ধারিত হয়। আমাদেরকে ঠিক করে দেয়া হলো- আমরা একটি ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম। পাকিস্তান হলো ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্র। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিন্তু হলো এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যারা প্রবক্তা, তারাই সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো উদযাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলো।
শিহাব শাহরিয়ার: উৎসবের নগরায়নে আপনি কি কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেন?
যতীন সরকার: গ্রাম থেকে নগরে আসা উৎসবগুলোতে কিছুটা পরিবর্তন তো এসেছেই। কারণ নগরের মানুষ একটা প্রতিবাদী ধারায় উৎসবকে বিন্যস্ত করে নিয়েছে। এই প্রতিবাদটা, ঐ যে বললাম, পাকিস্তানি ধর্মীয় যে গোঁড়ামি তার বিরেুদ্ধে। পাকিস্তানিরা যে বলত, এগুলো ভারতের হিন্দুয়ানী, তার বিরুদ্ধেই প্রগতিশীলদের এক সংঘবদ্ধ সাংস্কৃতিক অভিযাত্রাই নগরের উৎসবের নবরূপ। তবে পাকিস্তানিপন্থী এদেশের ধর্মবাদী মৌলবাদীরা প্রচণ্ডভাবে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছে। আমরা সেই প্রতিরোধের জাল ভেঙে দিয়েছি এবং এভাবেই আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিশেষ গতিবেগ প্রাপ্ত হয়।
শিহাব শাহরিয়ার: নগরে জীবিকাজীবীদের উৎসবগুলো কি করপোরেট আগ্রাসনে পড়েছে-আপনি কি মনে করেন?
যতীন সরকার: কর্পোরেট আগ্রাসন উৎসবের ওপর যে হয়নি বা একেবারে যে পরে নি তা নয়। যেমন আমি একটা দৃষ্টান্ত দেই- আমাদের এই নেত্রকোনারই একটা গ্রামে কুদ্দুস বয়াতির বাস। সে বিভিন্ন গ্রামে যে গান গাইতো-কিচ্ছা গান এবং এই গান এতো চমৎকার করে পরিবেশন করতো যে গ্রামের সমস্ত মানুষ তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতো। রাত, অনেক রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলতো এবং এর পেছনে একটা স্বতঃস্ফূর্ততা বিদ্যমান ছিল। অথচ কুদ্দুস বয়াতি এখনো জীবিত আছে কিন্তু তাকে শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং শহরে বিশেষ করে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে, বিভিন্ন জায়গায় তাকে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে কুদ্দুস বয়াতি সেই আগের কুদ্দুস বয়াতি নেই। আগে সে যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে যুক্ত থেকে গান করতে পারত, এখন আর সেটা করতে পারে না। তবে তার আর্থিক উন্নতি হয়েছে। সেই আর্থিক উন্নতির পিছনে মুনাফা লোভিরা তাকে নানাভাবে ব্যবহার করছে।
শিহাব শাহরিয়ার: উৎসবের আলোকে ধর্মান্ধরা ভয় পায় কেন?
যতীন সরকার: আসলে আমরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি বহু ত্যাগের বিনিময়ে। আমাদের নারীদের মানের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে। কিন্তু প্রতিষ্ঠা করার পরেও দেখা গেল, আমাদের এই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যারা বিরোধী ছিল তারা কিন্তু থেমে নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে শুরু করে চার নেতা হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, এগুলো প্রকৃত প্রস্তাবে যারা করেছে তারা সেই পাকিস্তানি ভাবধারারই বাহক। সেই ভাবধারার কারণে আজকের দিনে আমাদের উৎসবগুলোর বিরুদ্ধে নানানভাবে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে পাচ্ছে এবং এখানে ধর্মতন্ত্রের মৌলবাদীরা একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন জায়গায় এই ধর্মতন্ত্রের মৌলবাদীরা যে সমস্ত বক্তব্য-বিবৃতি দেয়, যে সমস্ত ওয়াজ-মহফিল করে, তার মধ্য দিয়ে এরা আমাদের উৎসবগুলোর বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলে এবং মানুষের মন বিষিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। সব মানুষের মন বিষিয়ে ফেলতে না পারলেও কিছু মানুষের মধ্যে যে এর কু-প্রভাব, অপপ্রভাব পড়ে না, একথা আমরা বলতে পারি না। এ কারণে আমরা দেখি যেটাকে আমি বলি- পাকিস্তান রাষ্ট্রকে হত্যা করে আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। সেই বাংলাদেশেই পাকিস্তানের ভূত এসে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। সেই পাকিস্তানের ভূতেরাই নানাভাবে আমাদের ঐতিহ্য নষ্ট করার চেষ্টা করছে। সেই বিনষ্ট করার যে অপচেষ্টা এরই একটা অংশ হচ্ছে আমাদের এই সর্বজনীন উৎসবগুলো বিরোধিতা করা।
তাদের এই যে বিরোধিতা- এ সম্পর্কে আগে যতটা সচেতন ছিলাম, আমরা কিন্তু এখন আর বেশি সচেতন নই। যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, যে বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলেছিলাম, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে সেই আন্দোলনে অনেক ভাটা পড়েছে। সেই ভাটা পড়ার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রজন্মের কাছ থেকে সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ব্যাপারটা অনেক দূরে চলে গেছে। এছাড়া আমাদের নতুন প্রজন্মও নানাভাবে অপসংস্কৃতির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। এই অবস্থা দূর করার জন্য সচেতন মানুষ যারা আছেন, তাদের উপরেই কিন্তু দায়িত্ব পড়েছে। সেই দায়িত্ব পালন করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের যে সংস্কৃতি, সেটা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা কিছুতেই আমাদের ঐতিহ্যকে নিয়ে সামনে এগোতে পারবো না। পাকিস্তানের ভূতেই সর্বেসর্বা হয়ে যাবে। কাজেই এর বিরুদ্ধে সত্যিকারের সচেতন মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে এবং নতুনভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
একটা জিনিস লক্ষ্য করবার মতো, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আছে যার সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন যুক্ত আছি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে উদীচী যারা করে কিংবা উদীচী’র মতো সংগঠন যারা করে তারা মূলতঃশহর বন্দরের সঙ্গেই যুক্ত। শহর-বন্দর ছাড়িয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে চেতনা যে কীভাবে বিদ্যমান, সেটার সঙ্গে যে যোগাযোগ রাখা, সেটা কিন্তু কেউ রাখে না। শহরের অপসংস্কৃতির যে অপপ্রভাব বরং গ্রামে গিয়ে পড়ছে। সেই গ্রামের মানুষের মধ্যে যে সময় মুকুন্দ দাসের জন্ম হয়েছিল, রমেশ শীলের জন্ম হয়েছিল, এরকম মুকুন্দ দাস, রমেশ শীলের মতো বহু প্রতিভা গ্রামে কিন্তু এখনও বিদ্যমান আছে। যারা এখনও গ্রামীণ সংস্কৃতি তথা আমাদের বাংলার আবহমানকালের সংস্কৃতি ধরে রাখতে চায়। কিন্তু তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার মতো কোনো শক্তি শহর-বন্দর থেকে গিয়ে কাজ করবে এমনটি প্রায় নেই বললেই চলে। একথা আমি উদীচীসহ বিভিন্ন সংগঠনের সম্মেলনে বলে থাকি। কাজেই এখানে যারা আমরা নগর-শহরে বাস করি এবং বাস করতে বাধ্য হই আমাদের জীবিকার প্রয়োজনে তাদেরও আসলে ঐ গ্রামের যে সংস্কৃতি তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য সর্বান্তকরণের চেষ্টা করতে হবে। এবং এই গ্রামীণ মানুষের মধ্যে সংস্কৃতি চেতনা নষ্ট করা হয়েছে, সেই সংস্কৃতি চেতনা নতুন করে জাগ্রত করতে হবে। না জাগিয়ে তুললে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে আমি মনে করি।
কাজেই এই যে উৎসব এগুলোকে আমাদের নতুনভাবে চিহ্নিত করতে হবে। যে উৎসবগুলোকে নষ্ট করা হচ্ছে, নানাভাবে বিকৃত করা হচ্ছে সেই বিকৃতির হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করতে হবে এবং সমস্ত ঋতু-উৎসবগুলো শহরের বিভিন্ন জায়গায় সীমাবদ্ধ করে রাখলেই চলবে না। এই ঋতু-উৎসবগুলোকে সত্যিকার অর্থে গ্রামের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বিস্তৃত করে দিতে হবে। গ্রামের সাধারণ মানুষ শহুরে নানান রকম অপসংস্কৃতির চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই অপসংস্কৃতির হাত থেকে আমাদের সমস্ত গ্রামীণ মানুষগুলোকে মুক্ত করে আনতে হবে। সেই মুক্ত করার জন্য একটা সচেতন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেই সচেতন আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমাদের ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো নতুন করে প্রাণ পাবে। আর নতুন করে প্রাণ পেলেই আমাদের জাতীয় চেতনা নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠবে।
শিহাব শাহরিয়ার: কৃষিজীবীদের বিনোদন উৎসবগুলো নগরে কি হারিয়ে যাবে? আপনার কী মনে হয়?
যতীন সরকার: আমাদের মূল সংস্কৃতির বিকৃতি শহরেও কিছুটা যে হয়েছে, সেখানেও ঐতিহ্য ও মূল ধারার সংস্কৃতিকে ধরে রাখার প্রবল প্রয়াস রয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় সেই প্রয়াস সফলও হয়েছে। আমি আগেই বলেছি, আমাদের যে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো রয়েছে, তারা যদি আরো বেগবান হয়, তাহলে গ্রামাঞ্চলসহ শহরের যে উৎসবগুলোতে কর্পোরেটদের আগ্রাসন সেটি বন্ধ হবে এবং আমরা প্রকৃত সংস্কৃতিকে খুঁজে পাবো। অর্থাৎ ঋতুভিত্তিক যে উৎসবগুলো, সেগুলো পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। আমি মনে করি, শহরেও যে ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলোতে কিছুটা বিকৃতি হয়েছে, সেগুলোও আমাদের সংস্কৃতির মূলে ফিরে যাবে।
শিহাব শাহরিয়ার: নগরের উৎসবগুলোতে সব পেশার মানুষের অংশগ্রহণ কি থাকে?
যতীন সরকার: শহরে উৎসবে সব পেশা ও শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের কথা বলতে গেলে এখানে কিছুটা রাজনীতির কথা এসে যায়। আসলে শ্রেণি বিভক্ত সমাজে সংস্কৃতিও শ্রেণি বিভক্ত সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে যায়। কাজেই আমাদের যে সংস্কৃতির ধারা, সেটি উচ্চ শ্রেণির হাতের মুঠোয় গিয়ে তার স্বাভাবিক ধারাকে যে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে এটা সত্য। কিন্তু আমার আবার একে অর্ধসত্যও বলি। কারণ স্বাভাবিকভাবে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও আমাদের এখানে যে বিভিন্ন ধারায় ঐতিহ্যকে রক্ষা করার প্রয়াস দেখি, সেই প্রয়াসের মধ্যে সত্যিকার অর্থেই আমাদের আনন্দিত হওয়ার মতো, উল্লসিত হওয়ার মতো অনেক কিছু আছে বলে আমি মনে করি। এভাবেই সাংস্কৃতিক ধারা বজায় থাকবে। এছাড়া আমাদের গ্রামের সাথে যে সংযোগ সেটা অন্য দেশের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নি। যেমন পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা যেভাবে শহর ও নগর থেকে গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সেখানে আমাদের বাংলাদেশের মানুষ ঐভাবে গ্রাম ও গ্রামের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নি। এর প্রমাণ আমরা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবগুলোতে প্রত্যক্ষ করি। কেন করি? করি সেখানে যে শেকড়ের টান তা বিদ্যমান। কাজেই শেকড়েরর টান যতদিন বিদ্যমান থাকবে, ততদিন পর্যন্ত কর্পোরেটরা নষ্ট করে দেবে এ আমি বিশ্বাস করি না।
শিহাব শাহরিয়ার: উৎসব মর্মকথা নতুন প্রজন্ম কতটা জানতে পারছে বলে আপনি মনে করেন?
যতীন সরকার: এখানে আমাদের প্রবীণদের একটা বিরাট দায়িত্ব আছে। প্রবীণরা এক্ষেত্রে দায়িত্বটা যে পুরোপুরি পালন করেছে আমি মনে করি না। পালন করতে পারেনি বলেই তরুণদের মধ্যে আমাদের সংস্কৃতির মূলধারা, এটি বিস্তৃতভাবে প্রবাহিত করতে পারেনি। এখানে আমাদের প্রবীণ সমাজ যদি ঐ প্রকৃত দায়িত্ব গ্রহণ করতো তাহলে তরুণ সমাজের সঙ্গে যে একটা বিচ্ছিন্নতা রয়েছে, তরুণ সমাজের ওপর অন্য দেশের যে অপসংস্কৃতির প্রভাব পড়ছে, সেটা দূর করার জন্য সচেতন প্রবীণদেরকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং এটা করা সম্ভব বলেই আমি মনে করি।
শিহাব শাহরিয়ার: গ্রামগুলোও নগরের চেহারা পাচ্ছে- তাহলে কী উৎসব উদযাপনে ভাটা পড়বে?
যতীন সরকার: গ্রামের ক্ষেত্রে নাগরিকতার যে প্রবেশ ঘটেছে; এটা সত্য কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এই যে নাগরিকতার প্রবেশ গ্রামে ঘটেছে তাতে গ্রামীণ সংস্কৃতি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বা যাবে, সেটা আমার মনে হয় না। বরং গ্রামের সঙ্গে নগরের যে সম্পর্ক সেটা অনেকটা অনেকগুলো গ্রামকে কেন্দ্র করে যে নতুন নতুন শহরের মতো গড়ে উঠেছে, সেই শহর থেকেও রাস্তা-ঘাট বা যোগাযোগ ব্যবস্থার যে উন্নয়ন হয়েছে তাতে শহরের সাথে গ্রামের সম্পর্ক আরো গভীর হয়েছে। এই গভীর হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের সংস্কৃতি নষ্ট হওয়ার বদলে বরং আমাদের সংস্কৃতি উজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ ঘটেছে। গ্রাম এবং নগরের যে সংযোগ তাতে আমাদের ঐতিহ্যও রক্ষা হবে। এখানে অপসংস্কৃতি এসে গেছে বটে, তবে সব সময় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্থাৎ দুই বিরোধী শক্তির লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই নতুনের উদ্ভব ঘটে। সব সময় এটা হয়েছে, এখনও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে।
প্রকৃত অর্থে যে সুসংস্কৃতি বা মূল ধারার সংস্কৃতি, সেটারই সব সময় জয় হয়, আমাদেরও তাই হবে। সংস্কৃতি ধ্বংস হবে না বলে আমি মনে করি। কারণ গ্রামে আগে সাধক বাউলরা ছিল কিন্তু বর্তমানে এরকম বাউলশিল্পী না তৈরি হলেও, এক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে, যেমন আগে আমরা গ্রামে কোনো মহিলা শিল্পী দেখিনি, কোনো মহিলার যাত্রাগান, বাউল গান গাইতে দেখেনি বা শুনিনি। এখন যেমন দেখি নগর এবং গ্রামে মেয়ে বাউল শিল্পীরা গান গাইছে, যাত্রা বা পালা গানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তাই আগেকার জালাল খাঁ বা মুকুন্দ দাসের যুগ বা যুগেই সব সময় থাকবে, সেটা ঠিক না। এক্ষেত্রে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে যাবে, একটা নতুন গতিবেগ তৈরি হবে- এটিই আমি মনে করি। এখন এই মহিলাদের যে যাত্রা যুগ শুরু হয়েছে তা অবশ্যই সঠিক হয়েছে। এখানে বলা যায়, আগেকার মহিলারা যেভাবে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, সেই এখন মহিলারাই বিভিন্নভাবে শহর-বন্দরে চলে যাচ্ছে এবং সেখানে তারা বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে যে নতুন একটা জাগরণ দেখছি, সেই জাগরণ আগে কখনো হয়নি। আশা করা যায়, এই জাগরণের মাধ্যমেও আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরও নতুন মাত্রা পাবে, যেটিকে সদর্থক রূপান্তর বলা হয়, সেটিই ঘটবে।
শিহাব শাহরিয়ার: নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে উৎসব হলো বিনোদনের এক বিশাল মাধ্যম- কথাটা কি সত্যি?
যতীন সরকার: আমি মনে করি সব কিছুতেই রূপান্তর ঘটে। এই রূপান্তর নিরন্তর সামনের দিকেই যায়। কখনো কখনো পিছনে যেতে পারে তবে আমাদের প্রাচীন ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলোতে রূপান্তর ঘটেছে এবং এই রূপান্তরের মধ্যেই মানুষ প্রতিনিয়ত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নদী যেমন যেখান থেকে উৎপত্তি হয়েছে, সেখান থেকে সামনের দিকেই যায়। পিছনের দিকে কখনো যায় না। আমাদের যেমন নেত্রকোনায় মগরা নদী তিন ভাগে হয়ে গেছে, তাতে কখনো মনে হতে পারে ঐ বুঝি উৎপত্তি স্থলের দিকে যাচ্ছে কিন্তু তা তো যায় না- সামনের দিকেই যায়। সংস্কৃতি আসলে মরে না, সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত হয়ে সামনের দিকে যায়- এটিই আমার শেষ কথা।
তারা//