লোকসাহিত্য লোকমানসে রচিত হয় : তপন বাগচী
ড. তপন বাগচী একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক এবং লোকসাহিত্য গবেষক। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন ফোকলোর চর্চায়। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩-এর জন্য ফোকলোর ক্যাটাগরিতে মনোনীত হয়েছেন তিনি। ফোকলোর বিষয়ে তপন বাগচী রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’, ‘লোকগানের খোঁজে’, ‘লালন মতুয়া লোকসংগীত অন্বেষণ’, ‘লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ’ ইত্যাদি। এ ছাড়া লোকসাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন বই সম্পাদনা এবং সংকলন করার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। সম্প্রতি কথা হলো এই লেখক, গবেষকের সঙ্গে।
স্বরলিপি: প্রথমেই অভিনন্দন।
তপন বাগচী: অভিনন্দন কী কারণে? ১ জানুয়ারি থেকে আমাকে বাংলা একাডেমির চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদি সে-জন্য হয়, তবে আপনাদের সহযোগিতা চাই। আর যদি ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’র জন্য অভিনন্দন জানিয়ে থাকেন, তবে বলবো যে, আমার ফোকলোর গবেষণা স্বীকৃতি পাওয়ায় আমি আনন্দিত।
স্বরলিপি: আপনার কথা ধরেই যদি বলি- পালাগান, বাউলগান, লোকসংগীত বাংলার লোকজীবনের ভূষণ। লোকজীবনের পরিধি কোন পর্যন্ত?
তপন বাগচী: লোকজীবনই তো আমরা যাপন করি। দিনের ক্লান্তি মোচন করে সারারাত যে পালাগান হয়, তাতে তো সাধারণ মানুষের জীবনাভিজ্ঞতাই উঠে আসে। তাতে চিরায়ত মানুষের লৌকিক কাহিনি পরিবেশিত হয়। বাউলগানে লোকায়ত জীবনদর্শন প্রতিফলিত হয়। লোকসংগীতে থাকে লোকজীবনের সুর ও বাণী, এর কোনো পরিসীমা নেই। আধুনিক মানুষও লোকজীবনের বাইরে যেতে পারেন না। এই যে মানুষকে সম্মান জানাতে মাথা নিচু করি, কিংবা হাত বাড়িয়ে দিই এটিও লোকাচার। এই যে মুখোমুখি দুজন মানুষ এগিয়ে এলে একটু সরে গিয়ে অতিক্রম করি, তাও তো লোকাচার। তাহলে লোকজীবন তো আধুনিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। লোকজীবনই তথাকথিত পরিশীলিত হয়ে আধুনিক হয়েছে।
স্বরলিপি: মাতাল রাজ্জাকের গীতিমালা-সম্পাদনার কাজ করেছেন। এ ধরনের কাজে সংকট তৈরি হয় কোথায়?
তপন বাগচী: ‘মাতাল রাজ্জাক গীতিমালা’ সম্পাদনা করতে গিয়ে বড় বিপত্তিতে আছি। ২০১৪ সালে আমি মাতাল রাজ্জাকের বাড়ি যাই। সারাদিন গান শুনি। তার বড় ছেলে কাজল দেওয়ান আমাকে মাতাল রাজ্জাকের গানের সংকলন করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু নানান কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। ২০২১ সালে তিনি আমাকে পত্র লিখে সংকলন করার অনুরোধ জানান। তখন তিনিই আমাকে তার পিতার গানগুলো গুছিয়ে দেন। এটি প্রকাশিত হতে হতেই আরেকটি সংকলন প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাতে কাজল দেওয়ানের প্রদত্ত গানের চেয়ে কম গান রয়েছে। আমরা ওই বইয়ের চেয়ে ৫০টি গান বেশি রেখেছি। বিন্যাস ও সজ্জাও পৃথক। এতে মাতাল রাজ্জাকের গানের ভাণ্ডারী কাজল দেওয়ানের ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকা লিখেছেন রাজ্জাকের গানের শিল্পী মমতাজ বেগম। মাতাল রাজ্জাকের গান মাতাল রাজ্জাকের নামেই প্রকাশিত। আমি তো আমার লেখা বলে দাবি করিনি। তাহলে প্রথম বইয়ের প্রণেতারা দ্বিতীয় বইকে চুরি বলার সুযোগ কোথায় পান? তারা নিয়েছেন জীবদ্দশায় প্রকাশিত ছোট ছোট বই এবং রাজ্জাকের খাতা। তা তো সংরক্ষিত ছিল কাজল দেওয়ানের কাছেই। কাজল দেওয়ানই আমাকে দিয়েছে সেগুলো সংকলন করার জন্য। আরেকটি কথা, এই বই যখন প্রকাশিত হয়, তখন লোকসাহিত্যের কোনো কপিরাইট ছিল না। তাই এটি কোনো মতেই চুরি নয়। এটি আগের বইয়ের চেয়ে অধিকতর গান নিয়ে সুবিন্যস্ত একটি নতুন সংকলন। যেহেতু সংগ্রহ-উৎস এক এবং একই ব্যক্তির গান, তাই তারা মনে করছে ওই বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
স্বরলিপি: একজন গবেষক কী একজন সংগ্রাহকও? আপনার ভাবনা জানতে চাচ্ছি।
তপন বাগচী: গবেষক ও সংগ্রাহক ভিন্ন ব্যক্তি হতে পারেন। আবার একই ব্যাক্তি সংগ্রাহক এবং গবেষকও হতে পারেন। অন্যের সংগ্রহ থেকে গবেষণা করা যায়। যেমন লালনের গান সংগ্রহ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পরবর্তীকালে আরো অনেকেই। এখন সেগুলো সামনে রেখে গবেষণা করা যায়। আবার ‘হারামণি’ সংগ্রহ করেছেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন। তিনি সেসব নিয়ে সংকলন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও করেছেন। তাই তিনি সংগ্রাহক এবং গবেষক।
স্বরলিপি: সাহিত্য গবেষণার তত্ত্ব এবং তথ্য জাতীয় জীবনে কীভাবে কাজে লাগানো যায় বলে মনে করেন?
তপন বাগচী: কেবল সাহিত্য নয়, প্রতিটি গবেষণাতেই তত্ত্বের প্রয়োগ রয়েছে। আবার সকল গবেষণাই তাত্ত্বিক নয়। প্রায়োগিক গবেষণাও রয়েছে। প্রায়োগিক গবেষণা জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
স্বরলিপি: বর্তমানে লোকসাহিত্যের আদলে যে সাহিত্য রচনা করা হচ্ছে বা সংগীত এ সম্পর্কে কী বলবেন?
তপন বাগচী: লোকসাহিত্য রচনা করা যায় না। লোকসাহিত্য লোকমানসে রচিত হয়, বাহিত হয়, সংরক্ষিত হয়। সেগুলো থেকে কেউ সংগ্রহ করে তার লিখিত পাঠ তৈরি করতে পারেন।
স্বরলিপি: বাংলার রূপকথায় বাঙালি জীবনের কোন দিকটি ধারণ করছে?
তপন বাগচী: বাংলার রূপকথা তো বাঙালির লোকমানসেই তৈরি হয়। রূপকথা মানে ‘রূপক-কথা’। রাজা-বাদশার রূপকে বাঙালির জাতীয় জীবনের কথা তাতে ফুটে ওঠে। রাক্ষস-খোক্কসের রূপকে লেখা হয় সমাজের খলনায়কদের কথা। যাপিত জীবনের চিত্রই ফুটে ওঠে রূপক হয়ে।
স্বরলিপি: আপনি তো বাংলা একাডেমির পরিচালক। একই প্রতিষ্ঠানের প্রবর্তিত পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন, এ কথা কখন জানতে পারলেন? পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি জানতে চাই।
তপন বাগচী: হ্যাঁ, বছরের প্রথম দিন থেকে আমি ফোকলোর জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের চলতি দায়িত্বের পরিচালক। অর্থাৎ পরিচালক হিসেবে আমাকে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি যখন বাংলা একাডেমিতে যোগ দিইনি, তখনও আমার নাম পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছে বলে শুনেছি। আমি যখন সংকলন উপবিভাগের উপপরিচালক, তখনও আমার নামের প্রস্তাব এসেছে বলে শুনেছি। গবেষণা উপবিভাগের উপপরিচালক যখন ছিলাম, তখনও আমার নাম ছিল। যখন আমার নামে এই পুরস্কার ঘোষিত হলো, তখন আমি ভাগ্যচক্রে এই বিভাগের চলতি দায়িত্বে পরিচালক। পত্রিকার প্রেসবিজ্ঞপ্তি থেকে পুরস্কারের কথা জানতে পারি ঘোষিত হওয়ার রাতে। আমি কৃতজ্ঞ জুরি বোর্ড ও বাংলা একাডেমি নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের প্রতি। আমার আগে এই পুরস্কার পেয়েছেন বাংলা একাডেমিতে কর্মরত লেখক আবদুল হক, সরদার ফজলুল করিম, সুব্রত বড়ুয়া, বশীর আলহেলাল ও শামসুজ্জামান খান, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী, অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, আমিনুর রহমান সুলতান ও সাইমন জাকারিয়া, মোকারম হোসেনের মতো গুণীজন।
আরও আছেন আবু জাফর শামসুদ্দীন, মযহারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, নীলিমা ইব্রাহিম, তপন চক্রবর্তী, কবীর চৌধুরী, মনজুরে মওলা, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী। আবু জাফর শামসুদ্দীন, মযহারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, নীলিমা ইব্রাহিম, তপন চক্রবর্তী, কবীর চৌধুরী, মনজুরে মওলা, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তাদের কেউ কর্মরত থাকার সময়, কেই অবসরে যাওয়ার পরে পেয়েছেন।হবীবুল্লাহ সিরাজী পুরস্কার পাওয়ার পরে একাডেমিতে এসেছেন। তাদের সঙ্গে আমার নাম যুক্ত হচ্ছে ভেবেই অভিভূত হচ্ছি। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের জাতীয় পুরস্কার হিসেবে এই গুরুত্ব অনুভব করে আরো বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার সংকল্প করছি। কবি আবুল হোসেন, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ যে পুরস্কার পেয়েছেন, সেই পুরস্কার আমার হাতেও উঠবে জেনে আমি গর্বিত।
/লিপি