দাম কম হলেই পাঠক বাড়বে, আমি তা মনে করি না : মিতিয়া ওসমান
মুজাহিদ বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম
ময়ূরপঙ্খি শিশুকিশোরদের উপযোগী বই প্রকাশ করে। মিতিয়া ওসমান প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। তাঁর যোগ্য পরিচালনায় পথচলার ১০ বছরেই প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদে পাঠক-মন জয় করেছে। এই প্রকাশনা থেকে বাংলা-ইংরেজি দুই ভাষাতেই বই প্রকাশিত হচ্ছে। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত ময়ূরপঙ্খির স্বত্ত্বাধিকারী মিতিয়া ওসমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুজাহিদ বিল্লাহ
ময়ূরপঙ্খির পথচলার ১০ বছর পূর্ণ হলো। আপনাদের অভিজ্ঞতার আলোকে জানতে চাচ্ছি- শিশুরা আসলে কেমন বই পছন্দ করে?
শিশুদের বই পড়তে প্রভাবিত করে আসলে সে চারপাশে কী দেখছে তার উপর। তারা কী পড়ছে, কোন বিষয়গুলো তারা টিভি বা ইউটিউবে দেখছে সেসব বই তারা খোঁজে। যেমন মটু-পাতলু, সিন্ড্রেলা- এসব ক্যারেক্টারের বই তারা খুঁজতে আসে। তাদের পছন্দ ইউটিউব বা টিভি দ্বারা প্রভাবিত। তারা কী ধরনের বই পছন্দ করবে সে ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা রাখে বাড়ির বড়োরা। শিক্ষকরাও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। বাড়ির বড়োরা যখন ছোটোদের হাতে বই তুলে দিতে চান তখন তারা দেখেন যে বইটির ভেতরে শিক্ষণীয় কিছু রয়েছে কিনা। আমি বলবো না যে, শিক্ষণীয় কিছু খোঁজা খারাপ, তবে আমার মতে মাঝেমধ্যে কিছু গল্পের বই দেওয়া উচিত, যেটাতে আনন্দ পাবে। যখন শিশুদের শুধু শিক্ষণীয় বই পড়তে দেওয়া হয় তখন তাদের ভেতর পড়ার অনীহা চলে আসতে পারে। এ জন্য ছোটোদের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের হাতে ভালো বই তুলে দেওয়া উচিত। তাছাড়া আমরা দেখেছি, শিশুরা ভূতের গল্প এবং রং করার বই খুব পছন্দ করে।
শিশুদের প্রকাশনার ক্ষেত্রে কী ধরনের সংকট রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
শিশুদের বইয়ের বিষয়-নির্বাচনে এখনো আগের ধারাটিই চলছে। সবাই ঠাকুরমার ঝুলি, লোককাহিনী, ঈশপের গল্প বারবার বের করছি। ক্লাসিক বইগুলো প্রকাশনীতে বেশি প্রকাশ পায়। আমি আরেকটা বিষয় বলতে চাই- দেশে ৫ বছরের নিচে শিশুদের বই খুবই কম। অথচ এই সময় শিশু তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে পারে। বিশেষ করে টেলিভিশন ও ভিডিওর মাধ্যমে কল্পনার জগতে যে তারা প্রবেশ করে, সেখানে বইয়ের ভূমিকা খুবই কম। পৃথিবীর সব দেশে প্রি-স্কুল বাচ্চাদের জন্য বই তৈরি করা হয়। শিশুরা সেসব বই দেখে তাদের কল্পনার জগৎ বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়। এ ধরনের বই বাবা-মা ছেলেমেয়েদের সামনে খুলে গল্প পড়ে শোনায়, সন্তানকে কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। আমাদের দেশে এ ধরনের বই কেন হচ্ছে না বুঝতে পারি না। আর যদিও বা এসব বই লেখা হয় কিংবা প্রকাশ হয় তখন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যারা শিশুদের জন্য বই লেখেন, শিশুরা কী ধরনের গল্প চায়, কোন ধরনের গল্প তাদের জন্য উপযোগী এবং যারা ছবি আঁকেন কোন ধরনের ছবি শিশুদের জন্য উপযোগী, তাদের কল্পনার জগতে নিয়ে যেতে পারবে- এসব নিয়ে বেশি একটা ভাবেন বলে মনে হয় না।
আমি মনে করি, শিশুদের অন্যসব খেলনার পাশাপাশি বইও যে একটা খেলনা সেটা আমরা কখনো চিন্তা করি না। আমরা পাঁচ বছরের নিচের বাচ্চাদের জন্য একেবারেই বই ছাপানোর চিন্তা করি না। আমাদের দেশে শিশুদের জন্য ভালো বইয়ের প্রকাশক, লেখক এমনকি অলঙ্করণ শিল্পীর অভাব আছে। যখন শিশুদের মজা করে শেখার বয়স, সেই সময় আমরা তাদের জ্ঞান দিতেই বেশি উৎসাহ বোধ করি। এটি তাকে বই সম্পর্কে ভীতি এনে দেয়। আমরা শিশুদের বই পড়ায় উৎসাহিত করতে পারছি না। এরপর আসে প্রোডাকশনের কথা। কাগজের উচ্চমূল্য তো আছেই, শিশুদের বই তো নানা ধরনের হতে পারে। যেমন কাপড়ের বই, হার্ড কভার, বোর্ড বাঁধাই। এসব বই বানানোর পর যে দাম পড়ে সেই দামে তো ক্রেতারা বই কিনতে চান না। এটাও বড় সংকট।
অনেক অভিভাবক শিশুদের বেশি দাম বিয়ে বিদেশী বই ঠিকই কিনে দিচ্ছে কিন্তু দেশী বই তারা কিনছে না। এর কারণ কী হতে পারে বলে মনে করেন?
অবশ্যই এর প্রধান কারণ হচ্ছে বইয়ের প্রোডাকশন, ইলাস্ট্রেশন। লেখার চেয়ে এ দুটো গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মা যখন বই কিনছে তারা কিন্তু ঈশপের ইংরেজি ভার্সন কিনছে। ইন্ডিয়ান ক্লাসিক বই কিনে দিচ্ছে। এগুলো খুব ভালো প্রোডাকশনে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের শিশুদের বইয়ের মার্কেট একটু সেনসেটিভ। এখানে বেটার কোয়ালিটির বই বের করার জন্য বইয়ের দামটা একটু বেশি পড়ে যায়। অনেকেই যে যুক্তি দেখায়, বইয়ের দাম কম হলেই বইয়ের পাঠক বৃদ্ধি পাবে এ বিষয়টা আমি সমর্থন করি না। তাই যদি হতো শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি তাদের বইয়ের দাম কম থাকার পরও বেশি বিক্রি হতো তা কিন্তু হচ্ছে না।
আমাদের দেশে শিশুসাহিত্যিকের সংখ্যা বেড়েছে বলেই মনে হয়। সে তুলনায় শিশুসাহিত্যের মান কি বেড়েছে?
আমাদের দেশে যে প্রবণতা দেখা যায় কিশোর-সাহিত্যকে শিশুসাহিত্য বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। শিশুসাহিত্যের লেখকও তুলনামূলক অনেক কম। ময়ূরপঙ্খী নতুন এবং তরুণদের নিয়ে বেশি কাজ করে। আমাদের বেশিরভাগ বইয়ের লেখক তরুণ। আমরা অনেক আঁকিয়েরও প্রথম বই প্রকাশ করেছি। কারণ শিশুদের বইয়ের ক্ষেত্রে লেখক এবং আঁকিয়ে দুজনই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে অভিভাবক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
বাবা-মার একটা বড় ভূমিকা থাকে। যদি কোনো পরিবারে বই পড়ার চর্চা না থাকে তাহলে তো শিশুদের হাতে বই আসবে না। অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মায়েরা শিশুদের যে বই কিনে দেয় সেটা প্রয়োজনের জন্যই। তাদের পাঠাভ্যাসের জন্য নয়। এখন অনেক শিক্ষিত বাবা-মা শিশুদের বই কিনে দিচ্ছে। তারা সাধারণত ইংরেজি বইকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষক এবং লাইবেরি বড়ো ভূমিকা পালন করে। শিক্ষক যদি শ্রেণিকক্ষের বাইরে তাদের বই পড়তে উৎসাহিত করেন তাহলে শিশুরা বেশি উৎসাহিত হতে পারে।
তারা//