অনেক সমস্যা খুঁজে পেয়েছি, এগুলো থেকে বের হতে হবে : আফসানা বেগম
স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ে সরকারকে সহায়তা ও পরামর্শ প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক আফসানা বেগম। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম, সম্প্রতি শুরু হওয়া বিভাগীয় বইমেলা, বই বিতরণ, প্রকাশকদের সঙ্গে সমন্বয়, প্রতিষ্ঠানটির সমস্যা ও সম্ভাবনাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরলিপি
রাইজিংবিডি : দায়িত্ব নেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই আপনি বিভাগীয় বইমেলার মতো একটি বড় আয়োজন শুরু করেছেন। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক অনেক কাজ নতুন করে সাজিয়ে করতে হচ্ছে। নানা বিষয়ে ‘সংস্কার’ করে এগুতে হচ্ছে। বইমেলায় এর ইতিবাচক প্রভাব আমরা কতটা দেখতে পাবো?
আফসানা বেগম : বিভাগীয় বইমেলা আগে হতো অক্টোবরে, এবার দেরিতে শুরু করতে হয়েছে। কারণ, আমি নিয়োগ পেয়েছি সেপ্টেম্বরে। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম কাজ ছিল— আগের বছরের অনুদানের বইগুলো বিতরণ করা। কোন বইগুলো বিতরণ করবো এ সিদ্ধান্তও আমাদের নিতে হয়েছে। কারণ বইগুলো বিগত সরকারের আমলে সিলেক্ট করা ছিল। সঙ্গত কারণে সেখান থেকে অনেক নিম্নমানের বই বাতিল করে নতুন বই যুক্ত করতে হয়েছে। এর মধ্যে দিয়েই নীতিমালা ‘রিরাইট’ করা, অর্গানোগ্রাম কেমন হওয়া উচিত; গ্রন্থকেন্দ্রের কাজের জন্য লোকবল কতটা প্রয়োজন সেগুলো ঠিক করতে হয়েছে। এখানে এসে দেখলাম, গ্রন্থকেন্দ্রের কাজের জন্য যত লোকবল প্রয়োজন ততটা নেই। ফলে কী, কী প্রয়োজন সেগুলো আগে ঠিক করলাম। তারপর মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন করলাম। মৌখিকভাবে সেগুলো অনুমোদিত হয়ে আছে। তারপর হঠাৎ চলে এলো বইমেলা।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের জন্য উল্লেখযোগ্য একটা কাজ হচ্ছে বিভাগীয় বইমেলা। আগে জেলা, উপজেলা বইমেলা ছিল কিন্তু বিভাগীয় বইমেলা শুরু হয়েছে গত বছর থেকে। বৃষ্টির দিনে বইমেলার আয়োজন করলে জমবে না, আবার আগে আগে না করা গেলে একুশে বইমেলা চলে আসবে— বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ৮টি বিভাগের জায়গায় ৫ বিভাগে বইমেলা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই সিদ্ধান্তের পেছনে বিভাগীয় মেলা কমিটি, বাংলা একাডেমি, গণ গ্রন্থাগার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং আমাদের প্রতিনিধিত্ব আছে।
এখানে একটি কথা জানিয়ে রাখি, সাধারণত বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির (বাপুস) সভাপতি এবং সহ-সভাপতি এই মিটিংয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাপুসের কাউকে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও তাদের আমরা নিয়ম অনুযায়ী চিঠি পাঠিয়েছি কিন্তু চিঠির উত্তর আসেনি। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নেই, আমাদের হাতে যেহেতু সময় কম, সেজন্য আমরা পাঁচটি বিভাগে মেলার আয়োজন করবো— ঢাকা, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ।
বুঝতেই পারছেন, এতো অল্প সময়ে এই আয়োজন ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের মতো ব্যাপার। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রথম সমস্যা দাঁড়ালো বিভাগীয় বইমেলাতে যেসব প্রকাশনী স্টল বরাদ্দ পায় তাদের একটা তালিকা আসে বাপুস থেকে, তারাই ঠিক করেন— কোন মেলায় কারা যাবে। তারা যেহেতু টোটালি সাইলেন্ট তাই আমরা তালিকাটা জানতে পারিনি। তাহলে আমরা কীভাবে ঠিক করবো— কারা যাবে? এ পরিস্থিতিতে সবাই মিলে একটা কমিটি ঠিক করলাম, সিদ্ধান্ত হলো দুটি বড় পত্রিকায় ওপেন বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার। এরপর কিছু ক্রাইটেরিয়া ঠিক করা হলো। যেমন যারা স্টল বরাদ্দ চাচ্ছেন তাদের লাইসেন্স হালনাগাদ আছে কিনা, গত বইমেলায় তাদের কতগুলো বই প্রকাশ হয়েছে, আগের বছর বইমেলায় গিয়েছে কিনা ইত্যাদি। একটি উপকমিটি গঠন করা হলো। যেহেতু বাপুস-এর কাউকে পাচ্ছি না; তখন আমাদের পরিচালনা বোর্ডে যে দু’জন প্রকাশক প্রতিনিধি আছেন মাহরুখ মহিউদ্দিন এবং মাহাবুবুর রহমান; এদের নিয়ে আমরা উপকমিটির অন্যান্যরা বসে বইমেলার স্টলগুলো নির্ধারণ করি।
বাছাই প্রক্রিয়া যখন শেষ হলো, তখন আমাদের ওপর মেইন চাপটা এলো। বিভিন্ন পথ ও মতের লোকেরা নিজেদের মতো করে বাপুস-এর মতো সংগঠন গড়ে তুলতে চাইছেন। কেউ রেজিস্ট্রেশন করেনি, কেউ আবার সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন করেছেন; যেটা আসলে ঠিক বাণিজ্যিক রেজিস্ট্রেশন নয়। এমন আলাদা আলাদা অন্তত তিনটি দল বলতে শুরু করলো যে, যেসব প্রকাশক গত ১৫ বছর বা তারও বেশি সময় সরকারের সুবিধাভোগী ছিলেন, নানাভাবে সুবিধা আদায় করেছেন, তাদের যেন আমরা বাদ দেই। সেখানে আমরা বলেছি, যেহেতু ওপেন একটা বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, তখন আমাদের কোনো এখতিয়ার নেই কাউকে ‘আবেদন করতে পারবেন না’ এ কথা বলার। তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো কমপ্লেইন থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে অন্য অথরিটি সিদ্ধান্ত নেবে। সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো তদন্ত জারি থাকে এবং আমাকে নির্দেশনা দেওয়া হয় যে, এই-এই প্রকাশনীকে অংশগ্রহণ করতে দিতে পারবেন না; আমি তখন সেই নিয়ম মেনে চলবো। কিন্তু আমার ওপর এ রকম কোনো নির্দেশনা আসেনি।
আবার এই দলগুলোতে এমন অনেকেই আছেন, তারা আসলে বিগত বছরগুলোতেও সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। তবে হয়তো তারা এখন যাদের বিরোধিতা করছেন, ততটা পাননি। যাই হোক, আমি শুধু বলেছি, আপনারা যদি এসে বলেন, ওদের ঢুকতে দেওয়া যাবে না। আমি যদি সে কথা মানি, তাহলে আবার অন্য মতের লোক সরকারে যখন আসবে, তারাও আবার আপনাদের ঢুকতে দেবে না। তাহলে এই প্রবাহ চলতেই থাকবে। আমি তাদের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আসলে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ যাদের আছে, সে ক্ষোভের জন্য আমি দায়ী নই। কিন্তু সেই ক্ষোভের কিছু উত্তাপ আমাকে নিতে হবে, সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। এটুকু মেনেই আমি এই দায়িত্বে বসেছি।
রাইজিংবিডি : বইমেলা মানে লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলন মেলা। তাদের নিয়েই এই আয়োজন। কিন্তু এবার ময়মনসিংহ বিভাগীয় বইমেলার উদ্বোধনী মঞ্চে কবি-সাহিত্যিকদের দেখা যায়নি। তারা কি আমন্ত্রিত ছিলেন না?
আফসানা বেগম : পুরো বিষয়টি বলি, বিভাগীয় বইমেলার জন্য একটি বাজেট থাকে। সে অনুযায়ী ডিজাইন করে আমরা কাজটি ছেড়ে দেই বিভাগীয় প্রশাসনের ওপর। প্রস্তুতিমূলক মিটিংয়ে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিত্ব থাকে। আমরা কী চাই, আর ওদের পক্ষে কী কী করা সম্ভব সবকিছু নিয়েই মিটিংয়ে আলোচনা হয়। কথা ছিল, বইমেলা উদ্বোধন করবেন, যে বিভাগের বইমেলা, সেই বিভাগের একজন বুদ্ধিজীবী-লেখক-কবি বা সংস্কৃতি অঙ্গনের যে কোনো প্রথিতযশা ব্যক্তি। বইমেলায় লেখকদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সভা হবে, বুক রিভিউ সেশন হবে, সহিত্য নিয়ে আলাপ হবে। এগুলো উল্লেখ করেই আমরা বিভাগীয় প্রশাসনকে বাজেট দিয়েছিলাম। কিন্তু আগেই বলেছি, তাদের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। নিরাপত্তা থেকে শুরু করে সব কিছুই তারা দেখেন।
এবার আমরা শুরুতে প্রচারণার কাজটি এগিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। এ জন্য ময়মনসিংহে দু’জন কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছিলাম। তারা শহরজুড়ে মাইকিং করেছেন, প্রায় চারশো স্কুল-কলেজের তালিকা ধরে ধরে যোগাযোগও করেছি। প্রধান শিক্ষক ও প্রিন্সিপালদের বলা হয়েছে যে, তারা যেন শিক্ষার্থীদের বইমেলায় নিয়ে আসেন। এ ছাড়াও আমি ব্যক্তিগতভাবে চিঠি পাঠিয়েছি। দুটি ব্যান্ডপার্টি সারা শহরে, স্কুলে গিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বইমেলার কথা জানিয়েছে। আট হাজার লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। এই প্রচারণা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের নিজস্ব তহবিল থেকে করা হয়েছে। এবার এটি একটি নতুন সংযোজন।
এখন প্রশ্ন হলো— উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লেখক কেন নেয়? এর উত্তরে আমরা যতটা জানতে পেরেছি, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কৃতিকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এক গ্রুপের কাউকে ডাকলে আরেক গ্রুপের লোকজন অসন্তুষ্ট হন। কিছু অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এই অনিশ্চয়তার কারণেই তারা অনুষ্ঠানে লেখকদের ডাকেননি। পরবর্তী মেলাগুলোতে আমরা চেষ্টা করবো কীভাবে এই ব্যারিয়ার ভাঙা যায়।
রাইজিংবিডি : কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি— বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
আফসানা বেগম : কলকাতা বইমেলার ব্যাপারে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। আমি আমাদের ডেপুটি হাই কমিশনে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছি যে, আমন্ত্রণপত্র এসেছে কিনা? যেহেতু নিয়ম হলো, তারা আমন্ত্রণপত্র পাঠাবেন, তারপর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রকাশকদের নিয়ে যাওয়া, প্যাভেলিয়নে স্থান দেওয়া এবং পরিচালনার কাজ করবে। আমরা পজিটিভ ছিলাম। মিনিস্ট্রি থেকে আমাকে জানানো হলো, যেহেতু ভারতের ভিসা বন্ধ আছে, তারপরও যদি আমন্ত্রণপত্র পাওয়া যায় তাহলে প্রকাশক এবং সংশ্লিষ্ট যারা যাবেন, সবার ভিসা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিগন্যালে করা সম্ভব। গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে আমি পহেলা নভেম্বর প্রকাশক গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়কে মেসেজও পাঠাই। তিনি আমাকে ফোন করে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে বললেন, আমাদের এখানকার প্রকাশকরা আপনাদের ওপর রেগে আছেন; আমরা যেতে চাই আপনাদের বইমেলায়, কিন্তু আপনারা পারমিশন দেন না। কিন্তু আপনারা প্রতিবছর কলকাতা বইমেলায় অংশ নিচ্ছেন। এটা তো ঠিক আদান-প্রদান হচ্ছে না। আমাদের আপনারা কেন ডাকেন না?
আমার ধারণা ছিল তিনি কূটনৈতিক বিষয় নিয়ে বলবেন, কিন্তু তিনি সেদিকে একবারের জন্যও গেলেন না। তখন আমি বললাম, ‘ঢাকা বইমেলা’ নামে যে বইমেলা একসময় গ্রন্থকেন্দ্রের আয়োজনে হতো, সেটি আন্তর্জাতিক বইমেলা। ১৬তম বছরে বইমেলাটি বন্ধ হয়ে যায়। আমি সেই বইমেলা আবার চালু করবো। একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন করতে অন্তত এক বছরের প্রিপারেশন লাগে। কারণ আন্তর্জাতিক বইমেলার ক্যালেন্ডার আছে, সে অনুযায়ী সময় বের করতে হবে। এখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্ত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও যুক্ত। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে কমপক্ষে ৮ মাস সময় দিতে হবে।
আমি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়কে বললাম, ঢাকা বইমেলা আন্তর্জাতিক বইমেলা হবে, সেখানে আপনারা অবশ্যই অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু একুশে বইমেলা জাতীয় বইমেলা। এখানে বাইরের কোনো দেশই অংশগ্রহণ করতে পারে না। আন্দাজ করতে পারি, যদি সরকারি মহল থেকে গ্রিন সিগন্যাল না পান, তাহলে যদিও প্রকাশক গিল্ডই এর আয়োজক, তারপরও নিরাপত্তাসহ অন্যান্য দিক বিবেচনা করে তারা আসলে আমাদের আমন্ত্রণ জানাতে পারছেন না। যেহেতু ভিসা বন্ধ, এটা তাদের দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
যারা এর আগে কলকাতা বইমেলায় সফলভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, এমন ১৫-২০ জন প্রকাশককে ডেকে একটা মতবিনিময় সভা করেছিলাম। তারা প্রচণ্ড আগ্রহ দেখিয়েছেন কলকাতা বইমেলায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে এবং ঢাকা বইমেলায় ভারতকে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারেও। উপদেষ্টা মহোদয়ের সঙ্গেও কথা হয়েছে; যথেষ্ট কমিউনিকেশন হয়েছে। এবার এখানেই আমাদের থামা উচিত।
রাইজিংবিডি : বাংলা একাডেমি যদি একুশে বইমেলার দায়িত্ব জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে দিতে চায়, নিতে প্রস্তুত আছেন কিনা?
আফসানা বেগম : এটা যেহেতু একটি কল্পিত প্রশ্ন, তাই আমিও একটি কল্পিত উত্তর দিচ্ছি। আমাদের যে লোকবল আছে তা নিয়ে বিভাগীয় বইমেলার আয়োজন করতে হিমশিম খাচ্ছি। তবে যে অর্গানোগ্রাম চিন্তা করেছি সেটা যদি ফুলফিল হয় তাহলে সম্ভব। তার আগে নয়।
রাইজিংবিডি : জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র নিয়ে আপনার পরিকল্পনা জানতে চাচ্ছি। প্রতিবন্ধকতাও নিশ্চয়ই আছে। সব মিলিয়ে কোথায় কাজের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন?
আফসানা বেগম : এর মধ্যেই অনেকগুলো কাজের কথা আপনাকে বলেছি। এ ছাড়াও একটা টিম করেছি, যারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গত এক মাসে ৫০টি লাইব্রেরি দেখে এসেছে। এবং কিছু ফেইক লাইব্রেরি পেয়েছে। যারা শুধু কাগজে, কলমে আছে। অর্থাৎ পরিদর্শনের একটি উইং লাগবে। বইমেলার একটি উইং লাগবে, গ্রন্থাগারের জন্য আলাদা উইং প্রয়োজন। আইটি সেক্টরের জন্য আলাদা উইং লাগবে। আমরা আলাদা দুটি ওয়েবসাইট চালু করছি। একটি আগামী সপ্তাহে চালু হবে। এর মাধ্যমে প্রত্যেক লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত হতে পারবো। তারা কী করছে যেমন জানতে পারবো, তেমনি আমরা সেখানে বলে দেবো এ বছর আমরা কোন কোন বই দিতে যাচ্ছি। সেখান থেকে তারা তাদের পছন্দমতো বই বেছে নিতে পারবেন। আরেকটা ওয়েবসাইট হচ্ছে প্রকাশকদের যোগাযোগের জন্য। যেখানে প্রকাশনীগুলো তাদের প্রকাশিত বইয়ের সিনোপসিসসহ সমস্ত তথ্য যুক্ত করবেন। এটা হলে আমরা সহজেই গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটি তালিকা করতে পারবো। ক্যাটালগ নেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
কাজ করতে এসে প্রধান সমস্যা মনে হয়েছে, লোকবল কম। এখানে কারও কোনো সুনির্দিষ্ট কাজ নেই। আবার অনেক ধরনের কাজ করতে গিয়ে কোথাও ফোকাস নেই। আমার মনে হয়েছে ফোকাস থাকা উচিত। এর আগে যার যেভাবে সুবিধা সেভাবে নীতিমালা পরিবর্তন করেছেন। বিগত কয়েক বছর নিয়ম ছিল বঙ্গবন্ধু বিষয়ক ২০ শতাংশ বই কিনতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা ২০ শতাংশ কিনতেই হবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কতগুলো গবেষণাবিষয়ক বই হবে? সবচেয়ে ভালো জীবনী তো তিনি নিজেই লিখে গেছেন। আরও একশজন যখন তার জীবনী লিখছেন তখন মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এমন নিম্নমানের বই কেনা হয়েছে। এরকম অনেক সমস্যা খুঁজে বের করেছি। এগুলো থেকে বের হতে হবে।
এখানে যারা কাজ করছেন, তাদের যেন পদোন্নতির ব্যবস্থা থাকে, পেনশন থাকে, তাহলে এক্সপার্টাইজ তৈরি হবে। এখানে যারা কাজ করছেন, তারা যেন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারেন সেই জায়গায় সংস্কার করার চেষ্টা করছি।
দ্বিতীয়ত, অনুদান দেওয়া এবং বই বাছাইয়ের নীতিমালা পরিবর্তন করতে চাচ্ছি। পারসেন্টেজগুলো তুলে দিয়ে ভালো সাহিত্য, গবেষণা, প্রবন্ধ যেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোর-কিশোরীরা পড়তে পারে তার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। এ জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করেছি। এটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
সম্ভবনার জায়গাগুলো নিয়ে বলতে হলে বলতে হবে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র যেহেতু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে, সেহেতু তার কাজ করার সুযোগও বেশি। এই প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশের বই পৌঁছে দিতে পারে, বাংলাদেশের বইয়ের রাইটস সেল করতে পারে। আবার দেশেই আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করতে পারে। বাইরের দেশে আমাদের বইয়ের প্রচুর চাহিদা আছে। আমি ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছি, সেখানে দেখেছি অনেক দেশ আমাদের সাহিত্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারা জানে, আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এবার তিনশর মতো বই নিয়ে গিয়েছি। ইতালি, জার্মানি, বেইজিং, অনেকেই বলেছেন, আমরা এই প্রথম বাংলাদেশের এতো ভ্যারাইটি বই দেখলাম। সেখানে দুই-তিনটি প্রকাশনীর সঙ্গে রাইটস কেনাবেচার বিষয়ে কথা হয়েছে। স্প্যানিশ ভাষায় আমাদের একটা উপন্যাস অনূদিত হবে। একজন ল্যাটিন আমেরিকান প্রকাশক এটির মার্কেটিং করবেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকাশকদের এই সুযোগগুলো আমি তৈরি করে দিতে চাই। পরের বছর প্রকাশকদের নিয়ে যদি আমি ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় অংশ নিতে পারি, তাহলে প্রচুর সম্ভাবনা আছে আমাদের সাহিত্যকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার। অনুবাদ করে দেশের বই দেশে রাখলে, সারা পৃথিবী সেটা জানবে না। আমাদের এজেন্ট যুক্ত করতে হবে। বইয়ের রাইটস সেল করতে হবে কোনো এজেন্টের মাধ্যমে। আমাদের কাছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বই যেভাবে পৌঁছে যাচ্ছে, সেই পদ্ধতিতে আমাদেরকেও যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে।
নতুন করে চিন্তা করছি, প্রকাশকদের নিয়ে একটা কিছু করবো, লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে একটা কিছু করবো, লেখক, কবিদের নিয়ে কিছু করবো। বই প্রকাশনা উৎসবে সবাইকে যুক্ত করা যায় কীভাবে— এ সব বিষয় নিয়ে ভাবছি। কিন্তু আমার মাত্র পাঁচ-ছয়জনকে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এখানে অনেকগুলো পদ খালি পড়ে আছে। এখানে কোনো পেনশন সিস্টেম নাই, পোস্টগুলো সব ব্লক। অর্থাৎ পদোন্নতি নাই। ফলে এখান থেকে একজন কর্মী যখন আরেক জায়গায় ভালো চাকরি পায়, সে চলে যায়। এ কারণে এখানে দক্ষ কর্মী তৈরি হয় না। মন্ত্রণালয়কে আমি জানিয়েছি। এগুলো হয়তো বদলে যাবে। তখন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রতিটি কাজ আলাদা আলাদা পরিচালক বা উপ-পরিচালকের অধীনে পরিচালিত করা সম্ভব হবে।
ঢাকা/তারা