‘রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে মামলায় জড়ানো হয়েছে’
নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘আমাকে, জিয়া পরিবারকে এবং বিএনপিকে হয়রানি করার প্রয়াসে এবং রাজনীতি থেকে দূরে রাখার অপপ্রয়াস হিসেবে অনুমাননির্ভর ও কাল্পনিক অভিযোগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আমাকে জড়ানো হয়েছে।’
মঙ্গলবার পুরান ঢাকার বকশিবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী ঢাকার পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ ড. মো. আকতারুজ্জামানের আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে দেওয়া বক্তব্যে এসব কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট একটি প্রাইভেট ট্রাস্ট। এ নিয়ে কারো কোনো ভিন্ন মত নেই। প্রাইভেট ট্রাস্টটির আর্থিক কোনো অনিয়ম হয়েছে বলে ট্রাস্ট সংশ্লিষ্ট কারো কোনো অভিযোগ নেই। সরকারের কোনো ফান্ড দ্বারা অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন হয় নাই। কুয়েতের এককালীন অনুদান তৎকালীন পররাষ্টমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান কর্তৃক আনীত হয় মর্মে সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুদকের তদন্তে বৈদেশিক অনুদানপ্রাপ্তির বিষয়ে ভিন্ন দাবি কেউ করেননি। নিয়মিত এবং আইন বর্ণিত পন্থায় কোনো আপত্তিও বিজ্ঞ আদালতে উপস্থাপন করা হয় নাই।
তিনি আরো বলেন, মামলার অনুসন্ধান বা তদন্তকালে ১ নম্বর সাক্ষী হারুন অর রশিদ এমন কোনো দালিলিক বা সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেন নাই, যার মাধ্যমে তিনি দেখাতে পারেন যে, আমি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করেছি। অথচ কোনো রকম প্রমাণাদি ছাড়াই সাক্ষী হারুন অর রশিদ মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র এবং তার জবানবন্দিতে আমার বিরুদ্ধে একটা ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছেন যে, আমি নাকি আমার পুত্রদ্বয় এবং আমার আত্মীয় মোমিনুর রহমানকে দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করেছি।
প্রাক্তন এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিপরিষদের কতিপয় সদস্য প্রায়ই আমাকে জড়িয়ে জনসমক্ষে মিথ্যা বক্তব্য প্রচার করছে। সাক্ষী হারুন অর রশিদ জবানবন্দিতে আমাদের বিরুদ্ধে যেসব মনগড়া ও মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন তার সাথে সেই সব অপপ্রচারণার একটা সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। যা থেকে আপনি সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন, হারুন অর রশিদকে একটি বিশেষ কারণে এই মামলার বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হয়েছে।
এদিকে খালেদা জিয়া তার বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আদালতে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেছেন। তিনি এ মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়ার যোগ্য বলে দাবি করেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আত্মসমর্পণ করতে বেলা মঙ্গলবার ১১টা ৯ মিনিটে আদালতে যান খালেদা জিয়া। বেলা ১১টা ১৪ মিনিটে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর তিনি দুই মামলায় খালেদা জিয়ার আত্মসমর্পণ করেন। চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার সাফাই সাক্ষ্য থেকে এবং অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্ক থেকে অব্যাহতিপূর্বক অবশিষ্ট আত্মপক্ষ শুনানি গ্রহণের আবেদন করে শুনানি করেন তার আইনজীবীরা।
শুনানিতে তারা বলেন, গত ৩০ নভেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে অসমাপ্ত বক্তব্যের জন্য দিন ধার্য ছিল। ওই দিন আমরা আশা করেছিলাম, তিনি আদালতে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেবেন। কিন্তু হরতালে নিরাপত্তাজনিত কারণে তার আদালতে আসতে বিলম্ব হয়। আপনি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেছেন। তার জামিন মঞ্জুর করতে আমরা বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। আর দুই মামলায় অসমাপ্ত বক্তব্য না দিলে খালেদা জিয়ার ন্যায়বিচার বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
জামিনের বিরোধিতা না করলেও খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে অসমাপ্ত বক্তব্যের বিষয়ে বিরোধিতা করেন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল।
উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক বলেন, বক্তব্য দিতে আর কত সময় লাগবে? ১৩৪ পেজ লিখেছি। কনসিডার করব যদি বক্তব্য লিখিত আকারে দেন। আর বক্তব্য দিতে চাইলে দেবেন। তবে সেটা লিখব না, শুধু শুনব। প্রতিটা ওয়ার্ড লিখেছি। এভাবে কতদিন চলবে। আজকেই শেষ করবেন। আজকের মধ্যেই শেষ করতে চাই।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, আজকে কিছু বলবেন আর কিছু বাকি থাকলে লিখিত আকারে জমা দেবেন।
কাউকে বঞ্চিত করব না বলে বিচারক খালেদা জিয়াকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেন।
এরপর বেলা ১১ টা ৩৭ মিনিটে খালেদা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। চার মিনিট আজানের বিরতি বাদে টানা ২টা ২৪ মিনিট পর্যন্ত বক্তব্য দেন খালেদা জিয়া। এদিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানি শেষ হয়।
খালেদা জিয়াকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ায় বিচারকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী আব্দুর রেজ্জাক খান। এরপর তিনি বৃহস্পতিবার থেকে বৃহস্পতিবার মামলার ধার্য তারিখ রাখার আবেদন করেন।
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল এর বিরোধিতা করে বলেন, আগামীকাল ও পরশু দিন মামলার তারিখ ধার্য রয়েছে। আমরা ওই দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করব।
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক আগামী ১৯, ২০ ও ২১ ডিসেম্বর মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করেন। ওই দিন চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে তার বক্তব্য লিখিত আকারে জমা দিতে বলেন বিচারক।
এরও আগে গত ১৯ ও ২৬ অক্টোবর এবং ২, ৯, ১৬ ও ২৩ নভেম্বর অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় এবং চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থনে আদালতে বক্তব্য দেন।
উল্লেখ্য, গত ৩০ নভেম্বর দুই মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
এদিকে খালেদা জিয়ার আদালতে আসাকে কেন্দ্র করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা আদালতে হাজির হন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, রুহুল কবির রিজভী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, নজরুল ইসলাম খান, আব্দুল্লাহ আল নোমান, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মির্জা আব্বাস, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, আমান উল্লাহ আমান, আফরোজা আব্বাস, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, জয়নুল আবদীন ফারুক, খায়রুল কবীর খোকন, শায়রুল কবির খান প্রমুখ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন- ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, আব্দুর রেজ্জাক খান, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন, এ জে মোহাম্মদ আলী, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, খোরশেদ আলম, জাকির হোসেন ভূইয়া, হান্নান ভূঁইয়া, ওমর ফারুক ফারুকী, জয়নুল আবেদীন মেজবাহ, হেলাল উদ্দিন, নুরুজ্জামান তপনসহ শতাধিক আইনজীবী ।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ৮ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি দায়ের করে দুদক। এ মামলায় ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক।
এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে জিয়া অরফানেজ মামলাটি দায়ের করে দুদক। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এ মামলা দায়ের করা হয়। ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট দুদক আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
দুই মামলায় খালেদা জিয়াসহ অপর আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন বিচারক বাসুদেব রায় অভিযোগ গঠন করেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ডিসেম্বর ২০১৭/মামুন খান/রফিক
রাইজিংবিডি.কম