ঢাকা     সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১০ ১৪৩১

সাজা না খালাস, কী হবে এসকে সিনহার?

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ৫ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ০৯:৩২, ৫ অক্টোবর ২০২১
সাজা না খালাস, কী হবে এসকে সিনহার?

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (ফাইল ফটো)

বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ নজিরবিহীন। কারণ যিনি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার প্রধান স্তম্ভ তার দ্বারা এ রকম ঘটা অস্বাভাবিক। কিন্তু তেমনি এক বিরল ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছে ঢাকার নিম্ন আদালত। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেনি। 

মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) সবার দৃষ্টি থাকবে পলাতক সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের মামলার রায়ের দিকে। বিশেষ করে পুরো বিচারাঙ্গনের বিচারপতি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের আইনজীবীদের দৃষ্টি থাকবে সেদিকে। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও ওঠেনি। বিচার তো পরের কথা। তাই সাবেক প্রধান বিচারপতির মামলার রায়ে কি হয় সেদিকে দৃষ্টি থাকবে জাতির। তবে বাংলাদেশে আইনের শাসন সবার জন্য সমান। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। তাই রায়ে সঠিক বিচার পাবেন বলে আশা করছেন দুদকের আইনজীবী।

ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ (এসকে সিনহা) ১১ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালত এ রায় ঘোষণা করবেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর দুদক এবং আসামিপক্ষের আইনজীবীর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের এ তারিখ ঠিক করেন।

মামলার ১১ আসামির মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) কারাগারে আছেন।  ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান এবং একই এলাকার বাসিন্দা নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা জামিনে আছেন।  সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, ফারমার্স ব্যাংকের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায় পলাতক।

রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আশায় দুদকের আইনজীবী। কারাগারে ও জামিনে থাকা আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, দুদক আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তাই তারা খালাস পাবেন। মামলায় এসকে সিনহাসহ ৪ আসামি পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হয়নি।

দুদকের আইনজীবী মীর আহাম্মেদ আলী সালাম জানান, ‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রধান বিচারপতি ছিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সেই পর্যায়ে থেকে (প্রধান বিচারপতি) তার প্রভাবে ব্যাংকারদের মিসগাইড করে যে প্রসেসে লোন দেওয়ার কথা, যে প্রসেস ফলো করা উচিত ছিল, সে সমস্ত প্রক্রিয়া ফলো না করে তাদের লোন দেওয়ার আয়োজন করা হয়। তারা টাকাগুলো হস্তান্তর, রূপান্তর এবং ছদ্মাবরণ করে মানিলন্ডারিং করেছে। তিন ধারায় আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার নিবেদন করেছি।’

তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় এস কে সিনহা তার পদ ও পদবীকে অপব্যবহার করে ব্যাংকারদের ইউজ করে, তাদের মিসগাইড করে দুটো অ্যাকাউন্ট তৈরি করেন। টাঙ্গাইলের দুইজন নিরীহ মানুষকে দিয়ে এসকে সিনহার অ্যাকাউন্টগুলো খোলান। অর্থাৎ টোটাল জিনিসটা একটা অবৈধ পন্থায় নিয়ে গেছেন তিনি। তার এ অভিযোগের বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়ের করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। এজন্য তাদের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেছি।’

মীর আহাম্মেদ আলী সালাম বলেন, ‘এটা দুর্নীতির একটা পরিস্কার কেস। সমস্ত ডকুমেন্ট আমরা সাবমিট করেছি। বিজ্ঞ আদালত যদি সঠিকভাবে পর্যালোচনা করেন, তাহলে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা দিবেন, দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিবেন।’

‘এটা একটা ঐতিহাসির রায় হবে। অপরাধ করলে তার নিস্তার নেই। অপরাধ যেই করুক, যে পর্যায়ের লোকই হোক তাকে সাজা পেতে হবে। অর্থাৎ আইন সবার জন্যই সমান। এটাই আমরা প্রমাণ করতে চাচ্ছি।’ বলে জানান মীর আহাম্মেদ আলী সালাম।

বাবুল চিশতি ও লুৎফুল হকের আইনজীবী শাহীনুর ইসলাম বলেন, ‘এ মামলার আসামি সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা সাহেব শুরু থেকে পলাতক আছেন। যে চার কোটি টাকা ঋণের কথা বলা হয়েছে এর অধিকাংশই পরিশোধ হয়ে গেছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে যাচাই বাছাই করে ঋণটা মঞ্জুর করা হয়। যখন ঋনটা মঞ্জুর করা হয় তখন এটা নিয়ে প্রশ্ন আসেনি। পরে বিভিন্ন ঘটনার ধারাবাহিকতায় এ বিষয়ে প্রশ্ন এসেছে।’

তিনি বলেন,‘বাবুল চিশতি ঘটনাকালীন সময়ে ছিলেন অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এবং লুৎফুল হক ব্যাংকার। চিশতি সাহেবকে জড়িত করা হয়েছে প্রত্যক্ষ প্রভাবে। লুৎফুল হক সম্পর্কে বলা হয়েছে কাগজপত্র যাচাই বাছাই না করে প্রস্তাবনা হেড অফিসে পাঠিয়েছে। সামগ্রিক বিষয়ে আমরা দাবি করেছি যেভাবে মামলাটি ফলপ্রসু করা হয়েছে এবং মামলাটির যে তথ্য উপাত্ত এসেছে সেখানে এ আসামিদের বিরুদ্ধে সাজা দেওয়ার সুযোগ নেই বলেই দাবি করেছি। কোনো ধারার অভিযোগ আমাদের সাথে যায় না। এজন্য আশা করছি, তারা খালাস পাবেন।’

গত বছর ১০ ডিসেম্বর মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। এর আগে একই বছর ১০ জুলাই দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন।

২০১৯ সালের ১০ জুলাই ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে একই বছরের ৯ ডিসেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন দুদক পরিচালক বেনজীর আহমেদ।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে সেই টাকা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর, উত্তোলন ও পাচার করেছেন, যা দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২)(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

গত বছর ১৩ আগস্ট একই আদালত ১১ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এরআগে গত ২৪ আগস্ট মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। মামলায় ২১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। গত ২৯ আগস্ট মামলাটিতে আত্মপক্ষ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তবে এসকে সিনহাসহ চারজন পলাতক থাকায় আত্মপক্ষ শুনানিতে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করতে পারেননি। অপর সাত আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান।

প্রসঙ্গত, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।

ঢাকা/টিপু


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়