ঢাকা     শনিবার   ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২০ ১৪৩১

মিয়ানমারের নাগরিকরা এদেশের মানব পাচার করছে 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৭, ১৯ আগস্ট ২০২৩  
মিয়ানমারের নাগরিকরা এদেশের মানব পাচার করছে 

ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নত জীবন-যাপনের আশায় মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছা পোষণ করে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ২২ জন তরুণ ও যুবক। পরে তাদের কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ট্রলারযোগে মিয়ানমার নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখানে তাদের নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করে চক্রটি। মিয়ানমার থেকে ট্রলারে পাচারকালে ১৯ যুবককে মিয়ানমার কোস্টগার্ড আটক করে। বাকি তিন যুবক অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পৌঁছে যায়। কিন্তু পাচারকারী চক্রের নির্মম নির্যাতনে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পরও ভুক্তভোগী এক যুবক জহিরুল ইসলাম মারা যান। বাকি দুই যুবক অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় রয়েছে বলেও জানায় র‌্যাব।

শনিবার (১৯ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। 

তিনি বলেন, শুক্রবার (১৮ আগস্ট) দিনগত রাতে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকায় অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের মূলহোতা তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

গ্রেপ্তার সদস্যরা হলেন- মুলহোতা মো. ইসমাইল (৪৫) ও তার সহযোগী জসিম (৩৫) এবং মো. এলাহী (৫০)। এ বছরের ১৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ১৯ জন যুবক মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে নৌ-পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় মিয়ানমারের কোস্টগার্ড কর্তৃক আটক হয়। পরে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা গত ১০ জুলাই নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে গিয়ে তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন জানান। এই ঘটনায় ১৫ এপ্রিল আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানায় একটি মানবপাচার আইনে মামলা দায়ের করেন। এই চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাচার হওয়া জহিরুল ইসলাম গত ২৪ মে মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে। এবং গত ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তার লাশ দেশে নিয়ে আসা হয়। 

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার ইসমাইল গত ২০০১-২০০৫ পর্যন্ত মালয়েশিয়া অবস্থানকালীন মিয়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল ও জামালের সাথে তার পরিচয় হয় এবং সখ্যতা গড়ে উঠে। পরে ইসমাইল দেশে ফিরে এসে মিয়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল এবং জামালের সাথে যোগসাজশে ১০-১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র গড়ে তোলে। স্থানীয় এজেন্টদের যোগসাজশে বাংলাদেশে মানবপাচার চক্রটির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণ ও যুবকদের কোন প্রকার অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর আশ্বাস দেয়। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পরে কাজ করে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে- এমন প্রলোভন দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ২২ জনকে পাচার করে। এরপর মিয়ানমারে তাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করতে অমানবিক নির্যাতন চালায়। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আদায় করা ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইল, জসিম ও আলম ৩০ হাজার টাকা করে টাকা করে নেয়। চক্রের অন্য সদস্যরা ১০ হাজার টাকা করে পেতো এবং বাকি ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া অবস্থানরত রশিদুলের কাছে মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করতো চক্রের বাংলাদেশ অংশের মুলহোতা মো. ইসমাইল।

যেভাবে পাচার হয় ২২ তরুণ ও যুবক

র‌্যাব জানায়, যেসব তরুণ ও যুবকরা মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছা পোষণ করত তাদের জসিম ও এলাহীসহ চক্রের অন্য সদস্যরা এই চক্রের মূলহোতা ইসমাইলের কাছে নিয়ে আসতো। তারপর তাদের নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসযোগে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের মানবপাচার চক্রের আরেক সদস্য আলমের কাছে হস্তান্তর করা হতো। টেকনাফের আলম ভুক্তভোগীদের কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে তাদের ট্রলারযোগে মিয়ানমারে জামালের কাছে পাঠিয়ে দেয়। পরে মিয়ানমারের জামাল তার ক্যাম্পে ভুক্তভোগীদের রেখে নির্যাতন করে এবং তা ভিডিও করে গ্রেপ্তার ইসমাইলের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করত। মুক্তিপণ দেওয়া না হলে ভুক্তভোগীদের নির্মমভাবে আরও বেশি নির্যাতন করা হত। যেসব ভুক্তভোগীর পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিত, তাদের মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুলের কাছে পাঠিয়ে দেয়। গ্রেপ্তার ইসমাইল নিজের ও অন্যান্য সদস্যদের অংশের টাকা রেখে অবশিষ্ট টাকা মালয়েশিয়া অবস্থানরত রশিদুলের কাছে মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিত। পরে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুল ও মায়ানমারে অবস্থানরত জামাল মুক্তিপণের টাকা তারা সমন্বয় করে ভাগ করে নিতো বলে জানা যায়। 

এদিকে, রশিদুল প্রায় ২৫ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে এবং প্রায় ২০ বছর ধরে মানবপাচার চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, এই চক্রটি গত ১৯ মার্চ মোট ২২ জনকে ট্রলারযোগে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাচার করার সময় মিয়ানমার উপকূলে পৌঁছালে মিয়ানমার কোস্টগার্ড ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। বাকি ৩ জনকে এই চক্রের সদস্য মিয়ানমারের জামাল কৌশলে ছাড়িয়ে তার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করতে থাকে। তাদের মধ্যে জহিরুলের পরিবারের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে চক্রটি। পরে জহিরুলের পরিবার গত ১০ মে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দেয়। বাকি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর দেবে বলে জানায়। পরে ভুক্তভোগী জহিরুলকে মে মাসের ২য় সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে সিঙ্গাপুরের পাশ দিয়ে মালয়েশিয়া (জোহার বারুত) পাঠানো হয়। নির্যাতনের কারণে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে মালয়েশিয়া পুলিশের মাধ্যমে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে গত ২৪ মে সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় তার মৃত্যু হয় এবং মৃত্যু সনদপত্রে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার শরীরে নির্যাতনের কথা উল্লেখ আছে বলে জানা যায়। 

পরে ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মালয়েশিয়া সরকারের তত্ত্বাবধানে জহিরুলের মৃতদেহ বাংলাদেশে এনে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এছাড়াও মায়ানমার কোস্টগার্ড কর্তৃক আটক হওয়া ১৯ জনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগের কার্যক্রম নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে চলমান রয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা। 

কীভাবে মানবপাচার চক্র গড়ে তোলেন ইসমাইল

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার ইসমাইল এই আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রটির বাংলাদেশের মূলহোতা। সে গত ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়া অবস্থান করে এবং দেশে ফিরে এসে ১০-১২ জনের একটি মানবপাচার চক্র গড়ে তোলে এবং অবৈধভাবে বিদেশে লোক পাঠাতো। সে প্রায় ১০-১২ বছর ধরে মানবপাচারের এই চক্রটি পরিচালনা করছে বলে জানা যায়। গ্রেপ্তার ইসমাইল নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করে এই চক্রের দেশে-বিদেশে অবস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সাথে সমন্বয় করে অবৈধভাবে মানবপাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে এবং ইতিপূর্বে সে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। 

ঢাকা/মাকসুদ/এনএইচ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়