ঢাকা     রোববার   ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২১ ১৪৩১

কোটাবিরোধী আন্দোলন

ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে অবরোধ, অসহনীয় যানজটে মানুষ

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০১, ৭ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৯:২৬, ৭ জুলাই ২০২৪
ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে অবরোধ, অসহনীয় যানজটে মানুষ

কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান বন্ধ রেখে আন্দোলন করায় এর প্রভাব পড়েছে পুরো রাজধানীজুড়ে। এতে ঢাকার শাহবাগ, বাংলামটর, নীলক্ষেত, তাঁতি বাজার, নিউ মার্কেট এলাকায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। অফিস ও ঘরমুখো মানুষ পড়েছেন চরম বিড়ম্বনায়।   

রোববার (৭ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৬টার দিকে এ রিপোর্ট লেখার আগ পর্যন্ত কোটা প্রত্যাহারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রেখেছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। এখানে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেখানে কোটার বিপক্ষে গান আর স্লোগানে স্লোগানে ব্লক করে রেখেছে পুরো এলাকা। একই অবস্থা সায়েন্স ল্যাব এলাকায়ও।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কেন্দ্রীয়ভাবে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী অবস্থান নিয়েছেন শাহবাগ মোড়ে। জাতীয় পতাকা মাথায় বেঁধে তারা কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এর আগে, দুপুর ৩টা ৫০ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে একটি মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ে এসে সবদিকের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বসে পড়েন। এতে সবদিকের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে পুরো ঢাকায়। সৃষ্টি হয়েছে অসহনীয় যানজটের। দুর্ভোগে পড়েছেন অফিস ফেরতগামী মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।

মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুর বাসার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত কবির আহমেদ। তিনি জানান, যানজটের কারণে আজকে মেট্রোরেলে আগারগাঁও নেমে সেখান থেকে মোহাম্মদপুর যাচ্ছেন তিনি।

প্রেসক্লাবের রাস্তায় একই স্থানে ঘণ্টাব্যাপী বসে আছেন মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এভাবে রাস্তা আটকে আন্দোলনে ব্যাপক জনদুর্ভোগ তৈরি হয়। আন্দোলন বা দাবি করে কোনও কর্মসূচি দেওয়া নাগরিক অধিকার ঠিক আছে, কিন্তু রাস্তা বন্ধ করে কেন?

কোটাবিরোধী আন্দোলনের জেরে রাজধানী ঢাকায় ঘরের বাইরে বের হওয়া মানুষ পড়েছেন সীমাহীন দুর্ভোগে। বেশিরভাগ সড়কে তীব্র যানজট। কোথাও আবার গাড়ি সংকট। দীর্ঘসময় ধরে সড়কে গাড়ির অপেক্ষায় থাকা অনেকে আবার পায়ে হেঁটে চলছেন।

এদিকে, সড়কের যানজট এড়াতে যারা মেট্রোরেলে গন্তব্যে যেতে চাচ্ছেন, তাদেরও পড়তে হয়েছে বিড়ম্বনায়। মেট্রোরেলেও আজ প্রচণ্ড চাপ। রাজধানীর বিজয় সরণী থেকে প্রেসক্লাব স্টেশনে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আসেন কুদ্দুস আহমেদ। তিনি বলেন, অন্যদিনের তুলনায় অনেক বেশি চাপ ছিল মেট্রোরেলে। আগারগাঁও এলাকায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করায় রাস্তায় যানবাহন ছিল না। ফলে বেশিরভাগ মানুষ মেট্রোরেলে উঠছেন। যাত্রীর চাপে গেট বন্ধ করতে বারবার সমস্যা হয়েছে। মাইকে বলা হয়েছে, যদি কেউ উঠতে না পারেন অনুগ্রহ করে পরের ট্রেনে আসেন।

প্রেসক্লাব স্টেশনে দেখা গেছে, ট্রেনে উত্তরার অভিমুখে যাওয়া এবং আগারগাঁওয়ের দিক থেকে আসা মানুষের প্রচুর ভিড়। উপরে ওঠার সিঁড়িতে উঠতেই যাত্রীদের চাপ লক্ষ্য করা গেছে। ভেতরে টিকিট কাউন্টারে লম্বা লাইন। মেশিনে যারা টিকেট কাটছেন, সেখানেও অনেক চাপ দেখা গেছে।

এদিকে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থী বলছেন, তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আছেন। দাবি মানা না হলে পরবর্তী কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামবেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৮ সালে সরকার কোটা বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটার বাস্তবায়ন চায় তারা।

রাত ৮টা পর্যন্ত তাদের অবরোধ কর্মসূচি চলবে জানিয়ে এরপর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও জানান তারা।

এর আগে, শনিবার (৬ জুলাই) বিকেল ৩টায় সারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রোববার ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

রাজধানীর ৬ সড়ক অচল

কোটাবিরোধী আন্দোলনের কারণে রাজধানীর ৬ সড়কে যান চলাচল এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। ফার্মগেট-শাহবাগ, গুলিস্তান-নিউ মার্কেট, শাহবাগ-পল্টন-মগবাজার রোড, শাহবাগ-সায়েন্স ল্যাব এবং শাহবাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশে সব সড়ক বন্ধ রয়েছে। 

পড়ুন: অচল শাহবাগ, তীব্র হচ্ছে যানজট 

শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, এসব এলাকায় কোনও ধরনের অপ্রীতিকর কিংবা নাশকতা কেউ যেন করতে না পারে, সে বিষয়ে আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি।

আন্দোলনকারীদের সড়ক অবরোধের কারণে ওই সড়কসহ আশপাশের সড়কে সারি সারি যানবাহন ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। এক প্রকার যান চলাচল বন্ধ। এসব সড়ক দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী-সাধারণকে পড়তে হয়েছে চরম দুর্ভোগে।
 
ডিএমপির ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) নবকুমার বিশ্বাস বলেন, কলাবাগান সায়েন্স ল্যাব, ধানমন্ডি, নীলক্ষেত আশপাশের এলাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে পুরো সড়ক বন্ধ হয়ে আছে। কোনো গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। তবে ধানমন্ডি থেকে গাবতলীর সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।

ডিএমপির কারওয়ান বাজার জোনের সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) স্নেহাশীষ কুমার দাস বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনের ফলে কোনও গাড়ি কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগের দিকে যেতে পারছে না। ফলে এ যানজট ফার্মগেট-তেজগাঁও ছাড়িয়ে বিজয় সরণি পর্যন্ত পৌঁছেছে। আজ সপ্তাহের প্রথম দিন সব অফিস আদালত খোলা থাকায় সড়কে গাড়ির চাপও বেশি।

পড়ুন: ‘বাংলা ব্লকেডের’ মিছিল শুরু, যান চলাচল বন্ধ

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল।

ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় বিক্ষোভ হয়। কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিলেন তখনকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে সরকারি চাকরিতে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে) সব ধরনের কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

২০২১ সালে সেই পরিপত্রের ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে’র অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। সেই রিটের রায়ে চলতি বছরের ৫ জুন পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। এরপর ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওইদিন এই আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগে পাঠিয়ে দেন চেম্বার আদালত।

সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছিলেন, সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে নাকি বাতিল হবে সে ব্যাপারে আপিল বিভাগ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

পরে গত ৪ জুলাই প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপাতত বহাল রাখার নির্দেশ দেন এবং এই রায় প্রকাশের পর রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত আপিল করার পরামর্শ দেন। 

পড়ুন: ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় অবরোধ

হাইকোর্ট কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করার পর থেকেই আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তারা ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রাখার দাবি জানাচ্ছেন।

পারভেজ/মাকসুদ/এনএইচ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়