অরিত্রীর মৃত্যু: মামলা তদন্তে গাফিলতি, বিলম্বিত বিচার
অরিত্রী অধিকারী
২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর নিজ বাসা থেকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। অরিত্রীর মৃত্যু নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে।সহপাঠীরা বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামে।বিষয়টি গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত।এ ঘটনায় ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকার ঘটনার পরের দিন পল্টন মডেল থানায় তিন শিক্ষিকার বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে মামলা করেন।মামলা তদন্ত করে থানা পুলিশ।এরপর তদন্তভার দেওয়া হয় ডিবি পুলিশকে।২০১৯ সালের ২০ মার্চ আদালতে দুই শিক্ষিকাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করা হয়। শ্রেণি শিক্ষিকা হাসনা হেনাকে অব্যাহতির সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের মতিঝিল জোনের টিমের তৎকালীন পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার।
চার্জশিটে তিনি উল্লেখ করেন, নির্দয় ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচরণে অরিত্রী আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়।
এই মামলার ৬ বছরেও বিচার শেষ হয়নি।২০১৯ সালের ১০ জুলাই দুই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু হয়।এরপর শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। মামলাটিতে ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত।গত বছর ২৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের তারিখ ধার্য করেন।তবে রায়ের তারিখ ৬ দফা পেছানো হয়। সর্বশেষ গত ২৫ জুলাই রায় ঘোষণার তারিখে ঢাকার ১২তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আব্দুল্লাহ আল মামুন পুলিশ ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) পুনরায় মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি পেয়েছেন আদালত মর্মে আদেশে উল্লেখ করেন বিচারক।
আদেশে বলা হয়, মামলার রায় প্রস্তুতের জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর নাজনীন ফেরদৌস, জিনাত আক্তার ও হাসনা হেনার বিরুদ্ধে মামলার পর পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. আবু সিদ্দিককে তদন্তভার দেওয়া হলেও পরবর্তীতে মহানগর পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে পুলিশ পরিদর্শক ডিবি পুলিশের মতিঝিল জোনের টিমের (পূর্ব বিভাগ) পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার তদন্তভার গ্রহণ করেন। তার দাখিল করা অভিযোগপত্রে মোছা. হাসনা হেনাকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। কামরুল হাসান সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তা স্বীকার করেন।'
তিনি জেরায় বলেন, ‘টিচার হাসনা হেনার কাছ থেকে ভিকটিমের (অরিত্রীর) পিতামাতা পরের দিন গিয়ে বিষয়টি জানতে পারেন। হাসনা হেনা পরের দিন তাদের বসিয়ে রেখেছিলেন। মূলত ভিকটিমের আত্মহত্যার ঘটনার পেছনে ফিরে গেলে দেখা যায়, ক্লাস টিচার হাসনা হেনার কাছে ভিকটিমসহ তার পিতা-মাতা প্রথমে যায় এবং তিনি তাদের অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখেন।
নথি পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, দিলীপ অধিকারী পল্টন মডেল থানায় মামলা করলে প্রথমে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত করলেও পরবর্তীতে মামলার তদন্তভার ডিবি পুলিশের ওপর ন্যস্ত হয়। কামরুল হাসান আসামি হাসনা হেনাকে ৬ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করেন। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরবর্তীতে ৯ ডিসেম্বর হাসনা হেনা জামিনে মুক্তি পান। তদন্ত কর্মকর্তা হাসনা হেনাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতির কারণ হিসেবে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, হাসনা হেনার বিরুদ্ধে অভিযোগে অভিযুক্ত করার মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি বিধায় তাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি প্রদান করলাম।
তদন্তকালে কামরুল হাসান ৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রথম পাঁচজন সাক্ষী অর্থাৎ হাসিনা বেগম, আতাউর রহমান, আফসানা আমতু রাব্বী, লুৎফুন নাহার কবির ও বিউটি অধিকারীর জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায়, জবানবন্দিগুলো হুবহু একই রকম। এমনকি প্রতিটা জবানবন্দিতে শব্দ, দাঁড়ি, কমা একই। অন্য চার জনের জবানবন্দিতেও একই বিষয় পরিলক্ষিত হয়। তাদের সাক্ষীও একইরকম। পরিতাপের বিষয় সাক্ষী আফসানা আমতু রাব্বীর জবানবন্দিতে লেখা আছে, ‘পরীক্ষা চালাকালীন পরীক্ষা হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকা আফসানা আমতু রাব্বী ভিকটিমের কাছ থেকে মোবাইলটি নিয়ে নেন এবং তাকে পরের দিন পিতা-মাতাসহ স্কুলে আসার জন্য বলেন।’ আফসানা আমতু রাব্বী তারও জবানবন্দিতে আমি শব্দটি ব্যবহার না করে তার নিজের নাম উল্লেখ করেছেন মর্মে দেখা যায়। এ থেকে বুঝা যায়, তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রত্যেক সাক্ষীকে পৃথক-পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেননি অথবা জিজ্ঞাসাবাদ করে নিজের মতো করে একই রকম বক্তব্য লিখে সাক্ষীর নামে চালিয়ে দিয়েছেন। আরও লক্ষণীয়, ঘটনার সময় উপস্থিত সাক্ষী ও অনুপস্থিত সাক্ষীদের বক্তব্য একই রকম। অধিকাংশ সাক্ষী তাদের জবানবন্দিতে ক্লাস টিচার হাসনা হেনার কথা উল্লেখ করেছেন।কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে অব্যাহতির সুপারিশ করেছেন।
এ বিষয়ে বিচারক আদেশে উল্লেখ করেন, কোনো মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার তদন্তকালে স্বাধীনতা ভোগ করলেও তিনি কোনোক্রমেই দ্য কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮ এ উল্লেখিত বিধি-বিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
একটি আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলার আসামিকে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দানের আবেদন করার ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন অথবা অন্য কোনোভাবে প্রভাবিত হয়েছেন মর্মে আদালতের কাছে প্রতীয়মাণ হয়।আসামি হাসনা হেনা অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার প্ররোচনার সামগ্রিক ঘটনার সাথে জড়িত আছেন মর্মে সাক্ষীদের জবানবন্দিতে উঠে আসলেও তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানিয়ে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
উপরের পর্যালোচনার আলোকে এই আদালতের সিদ্ধান্ত এই যে মামলাটি ন্যায়বিচারের স্বার্থে পুনরায় তদন্তে পাঠানো আবশ্যক। সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে দিয়ে মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে পুলিশ সুপার (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ) পুলিশ ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশে দেওয়া গেলো। পুনতদন্তকালে নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তার জামিনের শর্ত লঙ্ঘন না করা পর্যন্ত জামিনে থাকবেন।অভিযোগপত্রে অব্যাহতি হিসেবে উল্লেখিত আসামি মোছা. হাসনা হেনার বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা যথাযথ আইনুনাগ ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী রাহিমুল করিম হিমেল বলেন, ‘‘মামলার নথি বিচারকের কাছে রয়েছে।এখনো আদেশে স্বাক্ষর হয়নি। আদেশ প্রস্তুত হলে নথি ফেরত পাঠানো হবে’’
পিবিআইয়ের (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আওয়াল হোসেন খান বলেন, ‘‘আমরা আদালত থেকে এ ধরনের মামলার তদন্তের বিষয়ে কোনো আদেশ পাইনি।আদেশ পাওয়া সাপেক্ষে আমরা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করবো।’’
তদন্তের আদেশ পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ‘‘বিষয়টি আমার জানা নাই। আদালত বন্ধ হয়ে গেছে। খুললে এ বিষয়ে তথ্য দিতে পারবো।’’
এ বিষয়ে কামরুল হাসান তালুকদারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তবে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
অরিত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী বাদী হয়ে ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে মামলা করেন।
মামলায় ৩ জনকে আসামি করা হয়। মামলার পর ৫ ডিসেম্বর শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে ৯ ডিসেম্বর জামিন পান হাসনা হেনা। ১৪ জানুয়ারি নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তার আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।
২০১৯ সালের ২০ মার্চ নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার। আর শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনাকে অভিযুক্ত করার মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় তার অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
ঢাকা/এসবি