পুলিশের জন্য বিপর্যয়ের বছর ২০২৪
পুলিশের জন্য বিপর্যয়ের বছর ছিল ২০২৪। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুম, নির্মমতা এবং বিরোধী কণ্ঠ দমনে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে বিগত ১৫ বছরে। ছাত্রদের আন্দোলন গণআন্দোলনে রুপ নেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পুলিশের মারমুখী ভূমিকা ও রাজনৈতিক ব্যবহার। সঙ্গত ছাত্র-জনতার গণরোষের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনী বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
তারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মারমুখী আচরণের কারণে সরকার পতনের পর ট্রমায় পড়ে পুলিশ। সেই অবস্থা থেকে পেশাদার ও জনমুখী সেবাদানকারী সংস্থায় পরিণত করতে প্রয়োজন পুলিশে ব্যাপক সংস্কার। এই সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনও জরুরি।
তবে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, জনআস্থা ফেরানোর সব চেষ্টা করা হচ্ছে। বিতর্কিত ও পতিত আওয়ামী লীগের হয়ে পুলিশকে রাজনৈতিক ব্যবহারে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাদের কাউকে সরানো হয়েছে, কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। কাউকে করা হয়েছে সাসপেন্ড। কাউকে আবার তদন্তের আওতায় আনতে প্রত্যাহার করে রাখা হয়েছে।
পুলিশের এক পরিসংখ্যান বলছে, গত জুলাই-আগস্টে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। ২৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের একটি নামের তালিকা দেয়। প্রকাশিত তালিকায় নিহত পুলিশ সদস্যের নাম, পদের নাম, মৃত্যুর তারিখ, কোন ইউনিটে কর্মরত ছিলেন ও ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ পরিদর্শক, ১১ জন উপপরিদর্শক (এসআই), ৭জন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), ১ জন এটিএসআই, ১ জন নায়েক ও ২১ জন কনস্টেবল রয়েছেন।
পুলিশের দেওয়া তথ্যে ৪২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়। সরকার পতনের পর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ছাত্র-জনতার রোষের মধ্যে ডিএমপিসহ পুলিশের অধিকাংশ সুবিধাবাদী ও সরকারঘেঁষা আত্মগোপনে চলে যান। অনেককে গ্রেপ্তার বরখাস্ত, বদলিও করা হয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়ে বাংলাদেশ পুলিশ। থানা, ট্রাফিক স্থাপনায় হামলা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ সদস্যদের মারধর ও হত্যার ঘটনা ঘটে। বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে শুরু থেকেই মারমুখি ছিল পুলিশ। ছাত্রদের সেই আন্দোলনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক দমন-নিপীড়ন আর ধরপাকড়ে ছাত্রদের আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। কোটার আন্দোলন গিয়ে ঠেকে এক দফার আন্দোলনে। সেই আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগে ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড।
পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৬০৪টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৪৩, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭, মার্চে ৪৩, এপ্রিলে ৭৯, মে’তে ৪৩, জুনে ৩৬, জুলাইয়ে ১৭০, আগস্টে ৪২, সেপ্টেম্বরে ২৪, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯টি ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গত ১১ মাসে মামলা হয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৯৫৯টি। এর মধ্যে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৪১৯টি। জানুয়ারিতে ২৯, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩, মার্চে ২৫, এপ্রিলে ২৯, মে’তে ৩১, জুনে ৩৬, জুলাইয়ে ২৭, আগস্টে ৩৭, সেপ্টেম্বরে ৫৭, অক্টোবরে ৬৮ ও নভেম্বরে ৪৭। সংঘবদ্ধ ডাকাতির ঘটেছে ১১৫২টি। আর ১১ মাসে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৮০০টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৩১, মার্ডার ফেব্রুয়ারিতে ২৪০, মার্চে ২৩৯, এপ্রিলে ২৯৬, মে’তে ২৫৯, জুনে ২৬৮, জুলাইয়ে ৩৩৪, আগস্টে ৬১৪, সেপ্টেম্বরে ৫৮৩, অক্টোবরে ৩৯৯, নভেম্বরে ৩৩৭টি খুনের ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। গত ১১ মাসে ঘটেছে ১৬ হাজার ৩৬৬টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। জানুয়ারিতে ১০৪৩, ফেব্রুয়ারিতে ১৩৭১, মার্চে ১৫০৯, এপ্রিলে ১৬২৩, মে’তে ১৭৬৭, জুনে ১৬৮৯, জুলাইয়ে ১৭০২, আগস্টে ১০৭২, সেপ্টেম্বরে ১৫৭৮, অক্টোবরে ১৫৬০ ও নভেম্বরে ১৪৫২ ঘটনায় পুলিশ মামলা হয়েছে। অস্ত্র আইনে গত ১১ মাসে মামলা হয়েছে ১১৫১টি। জানুয়ারিতে ১২১, ফেব্রুয়ারিতে ১২৯, মার্চে ১২৮, এপ্রিলে ১১৭, মে’তে ১১২, জুনে ৯৮, জুলাইয়ে ১০৫, আগস্টে ৪৪, সেপ্টেম্বরে ১৫০, অক্টোবরে ১২০ ও নভেম্বরে ১৫৯টি। এই সময় বিস্ফোরক আইনে মামলা ৫৭৩টি, মাদক মামলা ৪৩ হাজার ৩১৬, চোরাচালানের ঘটনায় ১৭৫২টিসহ মোট ৫২ হাজার ৩৩৯টি রিকভারি মামলা হয়েছে।
ঢাকায় ১০ মাসে খুনের মামলা ৪৬০:
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যানুযায়ী, গত ১০ মাসে ঢাকার বিভিন্ন থানায় খুনের মামলা হয়েছে ৪৬০টি, এর মধ্যে সেপ্টেম্বরেই হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪৮টি। এছাড়া আগস্টে ১১৯টি, জুলাইয়ে ৫৯, অক্টোবরে ৫৮, মার্চে ১৮, মে মাসে ১৬, এপ্রিলে ১৪, জুনে ১৩, জানুয়ারিতে ১১ ও ফেব্রুয়ারিতে হত্যা মামলা হয়েছে ৪টি। আর এই সময় দস্যুতার ১৮৩, ডাকাতির ২৯, অপহরণের ৮৭ এবং চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫০৯টি। এর মধ্যে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দস্যুতার মামলা ৩৯, ডাকাতি ১৪, অপহরণের ৪৭ এবং চুরির মামলা ৯৬।
গণহত্যায় জড়িতদের তালিকা হচ্ছে:
পুলিশ হবে জনতার এমন শ্লোগানেই বেশি মুখর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেশিরভাগেই মাঠ পর্যায়ের সাধারণ পুলিশ সদস্য তথা পুরো বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে জনতার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিরোধী মত ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমনপীড়নে ব্যবহার করা হয়েছে। সরকার পতনের পর সেই কর্মকর্তাদের তালিকা করা হচ্ছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। গণঅভ্যুত্থান দমনে হত্যা, গণহত্যা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের তালিকা তৈরি করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) তদন্ত সংস্থা।জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের ঘটনায় অন্তত ৪৪৯ জন পুলিশ সদস্যকে ৩০০টি মামলায় আসামি করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই হত্যা মামলা। এসব মামলায় পুলিশের দুই সাবেক মহাপরিদর্শকসহ ১৭ কর্মকর্তা এবং বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের থেকে একটু উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আরও উন্নতি হওয়া দরকার। খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে যে চলে গেছে তা না।”
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলছেন, ‘‘গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে এতগুলো মানুষ মারা গেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন এশিয়ার ইতিহাসেও এমন নাই। এমন একটা ঘটনা ও পরিবর্তনের পরও আমাদেরও সক্ষমতায় কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। সব জায়গায় সঠিক লোকটা দিয়ে আমরা শেষ করতে পারিনি। আমাদের পুনর্গঠনের কাজটা কিন্তু চলমান। বদলি হচ্ছে।’’
‘‘আর ঢাকার অপরাধ জগতে নজরদারি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চৌকষ ও অভিজ্ঞ জনবল দরকার। সেখানে গণহারে সিনিয়র থেকে জুনিয়র সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। যার প্রভাবে বেড়েছে চুর, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। মনিটরিং ও তদন্তে মান বাড়াতে ঊর্ধ্বতন এবং অভিজ্ঞ, যারা বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসরে গেছেন তাদেরকেও আমরা সাথে নিয়ে ৮টা জায়গায় আলাদা মনিটরিং টিম করেছি।’’
ঢাকা/এসবি