কীভাবে বুঝবেন শিশু যৌন হয়রানির শিকার
প্রতীকী ছবি
এস এম গল্প ইকবাল : আপনার শিশুকে জানার পাশাপাশি যৌন নিপীড়নের লক্ষণগুলো জেনে রাখাও আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রত্যেক শিশু কোনো ট্রমার প্রতি অনন্য উপায়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, কিন্তু কিছু কমন আচরণ রয়েছে যা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুদের মধ্যে লক্ষ্য করা যেতে পারে। যেহেতু এসব লক্ষণের মধ্যে কিছু লক্ষণ অন্যান্য ফ্যাক্টর, যেমন- বিষণ্নতার কারণে হতে পারে, তাই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন কোনো একটি আচরণে সহসা সিদ্ধান্ত না নিতে।
জেনে নিন, কোন লক্ষণগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিৎ।
* হঠাৎ যৌন আচরণ করতে পারে : শিশুরা এসব আচরণ করলে তার সঙ্গে যৌন নিগ্রহের সংযোগ থাকার সম্ভাবনা বেশি। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত মন্টেফিয়োর মেডিক্যাল সেন্টারের অন্তর্গত দ্য চিলড্রেন’স হসপিটালের জে.ই. অ্যান্ড জেড.বি. বাটলার চাইল্ড অ্যাডভোকেসি সেন্টারের কার্যনির্বাহী পরিচালক কারেল আর. অ্যামারেন্থ বলেন, ‘তারা তাদের শরীর স্পর্শ করার জন্য আকাঙ্ক্ষা জানাবে, অন্য শিশুদেরকে শরীর স্পর্শ করার জন্য বলবে অথবা তাদের শরীর স্পর্শ করবে, নিজেদের শরীরকে স্পর্শ করার জন্য পিতামাতাকে বলবে।’ এটি তারা করে থাকে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নমূলক ঘটনাকে স্বাভাবিক করার জন্য। কখনো কখনো এটি শিশুদের পর্নোগ্রাফি দেখার লক্ষণ হতে পারে।
* হঠাৎ ভয়ের উদ্রেক হবে : যেমন, কোনো নির্দিষ্ট লোকের কাছে যেতে ভয় পাওয়া অথবা কোনো দৈনন্দিন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে ভীত হওয়া যা তাদের জন্য আগে স্বাভাবিক ছিল। ওয়াশিংটনে অবস্থিত হার্বারভিউ সেন্টার ফর সেক্সুয়াল অ্যাজল্ট অ্যান্ড ট্রমাটিক স্ট্রেসের পরিচালক লুসি বার্লিনার বলেন, ‘কারো কাছে যেতে না চাওয়া অথবা কারো সঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার তীব্র জেদ উদ্বেগের লক্ষণ হতে পারে যে তাদের সঙ্গে খারাপ কিছু হয়েছে।’ এটিও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে শিশুরা যৌন নিগ্রহকারী কি করেছে তা গোপন রাখতে পারে, যখন আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করবেন।
* ব্যক্তিত্বে হঠাৎ পরিবর্তন: যেমন- খুব শান্ত থেকে খুব আগ্রাসী অথবা খুব বহির্গামী থেকে খুব শান্ত ও অন্তর্মুখী হওয়া।
* খারাপ আচরণ করা : বিশেষ করে অন্যদের প্রতি ক্রোধ ও আগ্রাসন দেখানো। পেনসিলভানিয়ায় অবস্থিত লাসাল্লে ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী ডোনা ফিডলার বলেন, ‘শিশুরা যখন খেলনা নিয়ে খেলে অথবা সঙ্গীদের সঙ্গে খেলে তখন এটি প্রকাশ পেতে পারে, কখনো কখনো তারা অন্যদের আক্রমণ করতে পারে অথবা ভয় দেখাতে পারে।’ বয়স্ক শিশুরা যৌন নিগ্রহের পর অ্যালকোহল সেবন করতে পারে।
* স্লিপিং ডিসঅর্ডার দেখা দিতে পারে : যেমন- সচরাচরের চেয়ে বেশি ঘুমানো অথবা ঘুমাতে সমস্যা। ফিডলার বলেন, ‘শিশুরা গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি রক্ষার প্রতি অত্যধিক আসক্ত হবে, উদাহরণস্বরূপ- তারা বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দেবে।’
* আগুন ধরানো অথবা আগুনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ : ফিডলার বলেন, ‘আগুনের প্রতি আকর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে এবং আগুনের প্রতি আকর্ষণের সঙ্গে শিশুদের যৌনতার প্রতি অতি আগ্রহের সম্পর্ক থাকতে পারে (যা যৌন নিগ্রহ থেকে উদ্ভূত)।’ খুব অল্প বয়স্ক শিশুদের ক্ষেত্রে আগুন অঙ্কন অথবা লাল চিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে যৌন নিপীড়ন প্রকাশ পেতে পারে
* অস্বাভাবিক চিত্রাঙ্কন : শিশুদের চিত্রাঙ্কন যৌন নিপীড়ন ও এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষণ্নতার লক্ষণও প্রকাশ করতে পারে, যদি ছবিতে শক্তিশালী বা বড় লোকের মাঝে তাদেরকে অসহায় দেখায়, বলেন ফিডলার।
* খাবারের প্রতি হঠাৎ অনীহা দেখা দিতে পারে : যেমন- অতিরিক্ত খাওয়া অথবা কম খাওয়া। অ্যামারেন্থ বলেন, যেসব কিশোরী যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন তারা খাওয়া কমিয়ে দিতে পারেন অথবা মেদবহুল হতে চাইতে পারেন যাতে তাদেরকে যৌন নিগ্রহকারীর কাছে কম আকর্ষণীয় মনে হয়।
* যৌন নিপীড়নের শারীরিক লক্ষণ আছে কিনা লক্ষ্য করুন : যেমন- পেনিস বা যোনি থেকে তরল ক্ষরণ, যৌনাঙ্গে ব্যথা, শরীরে কালশিটে বা কাটা বা ক্ষত বা আঁচড়, শরীরে অস্বাভাবিক দাগ, ঘনঘন মূত্রত্যাগ অথবা মূত্রত্যাগ করতে সমস্যা। যদি আপনি এসব লক্ষণের যেকোনোটি দেখেন, তাহলে শিশুকে অবিলম্বে পেডিয়াট্রিশিয়ানের কাছে নিয়ে যান।
* আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে যা অস্বাভাবিক মনে হবে : এসবের মধ্যে ব্যক্তিত্ব, অভ্যাস, আচরণ ও পছন্দ-অপছন্দে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেতে পারে এবং বিশেষ করে শিশুরা যেসব করতে অভ্যস্ত তার প্রতি অনাগ্রহ দেখাবে, যেমন- খেলাধুলা, নাচের ক্লাস অথবা স্কাউটিং ইভেন্ট।
শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে বলে ধারণা করলে কি করা উচিত?
শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে- এটা কোনো পিতামাতাই প্রত্যাশা করেন না। কিন্তু কখনো কখনো এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এ অবস্থায় পিতামাতাকে শান্ত থাকতে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল চাইল্ড ট্রমাটিক স্ট্রেস নেটওয়ার্কের সদস্য এবং শিশু যৌন নিপীড়ন চিকিৎসার ডেভেলপার ইসথার এবলিনজার বলেন, ‘পিতামাতার শান্ত থাকা গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের নিজেদের ইমোশনাল আপসেট শিশুর মধ্যে ছড়ানো উচিত নয়। শিশুর কাছ থেকে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চাইবেন না অথবা শিশু আতঙ্কগ্রস্ত হয় এমনভাবে সতর্ক করবেন না।’
এর পরিবর্তে, আপনার শিশুকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষার জন্য সন্দেহভাজন নিগ্রহকারীর সঙ্গে সকল ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিন।
অ্যামারেন্থ বলেন, ‘যদি আপনি জানতে পারেন যে আপনার শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, বিশেষ করে যদি শিশুরা এ সম্পর্কে বলে, তাহলে আপনি প্রথমে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আপনার শিশুর বয়স ৫ বছরের নিচে হলে। কেন? ৫ বছরের কম বয়সের শিশুকে বিচারকার্যে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় না। তাই যদি আপনার শিশুর বয়স ৫ বছরের নিচে হয় এবং তারা স্পষ্টভাবে বলে যে কেউ তাদেরকে স্পর্শ করেছে, তাহলে পুলিশের কাছে যান। কারণ এই বয়সের শিশুরা কি ঘটেছে তা হুবহু বলতে পারলেও আইনত তাদেরকে নির্ভরযোগ্য সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, তাই মামলা-মোকদ্দমা এগিয়ে যেতে পারে না।’
যদি আপনি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাদের গোয়েন্দা বিভাগ যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত অতিরিক্ত প্রমাণ খুঁজে পেতে পারে, যা নিপীড়নকারীকে আইনের আওতায় আনতে সাহায্য করবে। ফিডলার বলেন, ‘পুলিশ আপনার সঙ্গে আলোচনা করবে যে নিপীড়নকারীকে কি করা হবে, বিশেষ করে যদি ঘরের কেউ অথবা পরিবারের কোনো ঘনিষ্ঠ সদস্য নিপীড়নকারী হয়ে থাকে।’
শিশু প্রতিরক্ষা কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ আপনাকে সাহায্য করতে পারে। এখান থেকে আপনি প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা তথ্য পাবেন। অ্যামারেন্থ বলেন, ‘শিশু প্রতিরক্ষা কেন্দ্রে আসা গুরুত্বপূর্ণ, যদি আপনি সন্দেহ করেন যে আপনার শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, কিন্তু আপনার শিশু আপনাকে নিশ্চিত হওয়ার মতো কোনো তথ্য দিচ্ছে না।’ এখানে প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর আপনার শিশুর সঙ্গে কথা বলে উদঘাটন করার চেষ্টা করবে যে সে যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে কিনা।
তথ্যসূত্র : ওয়েব এমডি
পড়ুন :
*
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ অক্টোবর ২০১৮/ফিরোজ
রাইজিংবিডি.কম