যেসব অর্থ-সম্পদের যাকাত আদায় করতে হয় না
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন || রাইজিংবিডি.কম
ইসলাম মানবতার ধর্ম। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ যাকাত। এই যাকাতের মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ধনীদের বা সম্পদশালীদের যাকাত আদায় করা, দ্বীন প্রতিষ্ঠার একটি অংশ। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইসলামের এই তৃতীয় স্তম্ভটির দায়িত্ব পালন করল সে যেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করল।
যাকাত ধনীদের সম্পদ পবিত্র করে এবং সম্পদে বরকত নিশ্চিত করে। পাশাপাশি দুস্থ, ফকির, মিসকিন, মুসাফির, অভাবগ্রস্তদের প্রয়োজন মেটায়। যাকাত গরিবদের নিশ্চিত অধিকার বা হক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা পবিত্র কুরআন কারীমে বলেছেন, ‘তাদের সম্পদে বঞ্চিত ও হাত বাড়িয়ে দেয়া ভিক্ষুকের অধিকার রয়েছে’। (সূরা যারিয়াত, আয়াত ১৯)
যাকাত প্রদানের ৮টি খাত রয়েছে। লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে তা উল্লেখ করা হয়নি। যাকাত বিষয়টি অনেক বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। আজ এখানে ‘যেসব অর্থ-সম্পদের যাকাত দিতে হয় না’ সে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করা হচ্ছে।
ঘরে ব্যবহারের জন্য যেসব আসবাবপত্র রয়েছে যেমন: কাপড়-চোপড়, থালা-বাসন, হাড়ি-পাতিল, ফ্রিজ-আলমারি, শোকেস, পড়ার টেবিল, ওয়াশিং মেশিন, বই ইত্যাদির উপর যাকাত হয় না। ঘরের আসবাবপত্র সেটা কম ব্যবহৃত হোক অথবা বেশি ব্যবহৃত হোক তাতে পার্থক্য নেই। তবে এ ক্ষেত্রে কেউ যদি ঘরের কোনো আসবাবপত্র পরে বিক্রয় করে অর্থ সঞ্চয় করার নিয়তে রাখে, তাহলে সেটির মূল্য হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হয়।
বসবাস করার উদ্দেশ্যে অথবা ভাড়া দেয়ার উদ্দেশ্যে যে সব ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা, ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয় বা ক্রয় করা হয়, সেসব কিছুর উপর যাকাত আসে না। একইভাবে একই উদ্দেশ্যে যদি জমি ক্রয় করা হয় এবং জমিতে চাষাবাদ করে ফসল ফলানোর নিয়ত করা হয়, অথবা জমির উপরে বাড়ি তৈরি করার নিয়ত করা হয়, যেখানে পরে বসবাস করা যাবে অথবা ভাড়া দেয়া যাবে, সেই ক্ষেত্রেও এই জমির মূল্যের উপর কোনো যাকাত আসে না। তবে এ সবের ভাড়া থেকে যে অর্থ উপার্জিত হয় তার উপর যাকাত দিতে হয়। আবার যদি ব্যবসা বা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে জমি ক্রয় করা হয় বা ফ্ল্যাট-বাড়ি তৈরি করা হয়, তাহলে এ সবের মূল্যের উপর যাকাত দিতে হয়।
শিল্প বা কল-কারখানা, যেখানে উৎপাদন করার উদ্দেশ্য থাকে, সেখানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, মেশিনপত্র, আসবাবপত্র, শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত গাড়ি ও যানবাহন, ইত্যাদির মূল্যের উপর যাকাত আসে না। তবে উৎপাদিত মালামাল, পণ্যসামগ্রী এবং শিল্প-কারখানায় মজুদ কাঁচামাল যা থেকে উদ্দিষ্ট শিল্প উৎপাদন করা হয়, সেগুলোর মূল্যের উপর যাকাত প্রদান করতে হয়।
পেশাজীবীদের উপকরণ, যেমন: কৃষকের ট্রাক্টর, মিস্ত্রির ড্রিল মেশিন, ইঞ্জিনিয়ারদের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ডাক্তারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন আসবাবপত্র ইত্যাদির উপর যাকাত হয় না। পেশাজীবী কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ওপর উশর নির্ধারিত হয়। তাছাড়া, পেশাজীবীদের পেশা থেকে অর্জিত অর্থ অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হয়।
সাইকেল, রিকশা, বেবি ট্যাক্সি, বাস, ট্রাক, লঞ্চ, স্টিমার, উড়োজাহাজ ইত্যাদি যা ভাড়ায় খাটানো হয় অথবা যা দিয়ে উপার্জন করা হয়, তার মূল্যের উপর যাকাত হয় না। তবে এ সব থেকে যে অর্থ উপার্জিত হয় তার উপর যাকাত দিতে হয়। তেমনি এসব যানবাহন যদি কেউ বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয় করে অথবা মজুদ করে রাখে, তবে তার মূল্যের উপর যাকাত আদায় করতে হয়।
কারো কাছে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে হিরা, মণি-মুক্তার অলঙ্কার থাকলে এবং তা ব্যবহৃত হলে, তার মূল্যের উপর যাকাত আসে না। তবে যদি এসব অলঙ্কার সঞ্চিত সম্পদ হিসাবে রাখা হয়, যে প্রয়োজন হলে বিক্রয় করে অর্থ পাওয়া যাবে অথবা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মজুদ রাখা হয়, তাহলে তার মূল্যের উপর যাকাত আদায় করতে হয়। (জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া, খণ্ড-১)
সরকারি ভবিষ্যৎ তহবিল বা জিপিএফ ফান্ড-এর অর্থ হাতে আসার আগে তার যাকাত আসে না। তবে চাকরিজীবী তার চাকরিকালীন স্বেচ্ছায় জিপিএফ ফান্ডে যা কর্তন করে, জমা রাখে, হাতে আসুক বা না আসুক তার উপর যাকাত আদায় করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণ কোম্পানিতে চাকরিরত ব্যক্তিদের প্রভিডেন্ট ফান্ড-এর টাকা হাতে আসুক বা না আসুক তার উপর যাকাত আদায় করতে হয়। একইভাবে সরকারি জিপিএফ ফান্ডের টাকার মাধ্যমে কোনো ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হলে বিনিয়োগকৃত সেই সম্পদের যাকাত আদায় করতে হয়। (আহসানুল ফাতাওয়া, খণ্ড-৪)
নাবালেগ বা পাগলের অর্থ সম্পদের যাকাত আদায় করতে হয় না। কারো কাছে টাকা পাওনা থাকলে, যদি সেই পাওনা টাকা আদায় হওয়ার বা ফিরে পাওয়ার আশা না থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত হয় না। তবে আশাহত হওয়ার পরে, কয়েক বছর পর যদি ওই টাকা ফেরত পাওয়া যায়, তাহলে বিগত যে কয়েক বছরের জন্য যাকাত দেয়া হয়নি, হিসাব করে সেই পরিমাণ যাকাত আদায় করে দিতে হয়।
মোটামুটি আলোচ্য সম্পদগুলোর ক্ষেত্রে উল্লিখিত অবস্থায় যাকাত হয় না। তবে এসব সম্পদ আয়ত্বে রাখার উদ্দেশ্য কী, তার উপর নির্ভর করে যাকাত আদায় করতে হয়। আল্লাহ আমাদের ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ, যাকাত আদায়ের মাধ্যমে, সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার তাওফিক দিন। আমিন!
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও মাসিক পত্রিকা সম্পাদক
ঢাকা/তারা