ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

ভ্রমণে ইসলামের বিধান এবং নারীর ভ্রমণ  

মাওলানা মুনীরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪০, ১৯ নভেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৪:০৩, ১৯ নভেম্বর ২০২২
ভ্রমণে ইসলামের বিধান এবং নারীর ভ্রমণ  

শীতকাল প্রায় এসে গেছে। এ সময় ভ্রমণবিলাসীরা ভ্রমণে বেরিয়ে থাকেন। ইসলাম এমন একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা ভ্রমণ করতেও মানুষকে উৎসাহিত করে।

ভ্রমণ বা পর্যটনের ধারা প্রথম নবী হজরত আদম আলাইহিস সালাম-এর সময় থেকে এখন পর্যন্ত চালু রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এটা নবী-রাসুলদের বাস্তব জীবনে ঘটিয়ে দেখিয়েছেন। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইসরা বা মিরাজও এই ভ্রমণের অন্তর্ভুক্ত।

নবী-রাসুল ছাড়াও ইতিহাসের পাতায় অসংখ্য বিশিষ্টজনের নাম পাওয়া যায়, যাঁরা পৃথিবীর নানা প্রান্ত ভ্রমণ করে অমর হয়ে আছেন। পবিত্র কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে ভ্রমণের বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওযা যায়। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কী হয়েছে। এই হলো মানুষের জন্য বর্ণনা। আর যারা ভয় করে তাদের জন্য উপদেশবাণী।’ (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ১৩৭-১৩৮)

একটানা অনেকদিন ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, পড়াশোনা ইত্যাদি করার ফলে অবসাদ ও একঘেয়েমি তৈরি হয়। তখন প্রিয় মানুষদের সঙ্গে প্রকৃতির কাছাকাছি দূরে কোথাও ঘুরে আসতে পারলে আগের একঘেয়েমি ভাব দূর হয়। মনে প্রশান্তি আসে। সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে নানামুখী জ্ঞান অর্জিত হয়। জীববৈচিত্র্যের স্বভাব-চরিত্রের ধারণা পাওয়া যায়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়। ভ্রমণ বা প্রকৃতি মানুষকে যে জ্ঞান দিতে পারে বইপত্র তা দিতে পারে না। 

‘প্রকৃতি-বই নিত্যদিনই দিচ্ছে নতুন পাঠ/ পাঠে পাঠে ঊর্বরা হয় সবার জ্ঞানের মাঠ।’ একজন মানুষ যতই দূরে যাবে এবং প্রকৃতিকে দেখবে, ততই তার জানাশোনার পরিধি বাড়বে। আল্লাহ তায়ালা জ্ঞান অর্জনের জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ভ্রমণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘তারা এ উদ্দেশে কেন দেশ ভ্রমণ করেনি যে, তারা জ্ঞানসমৃদ্ধ হৃদয় ও শ্রবণশক্তিসম্পন্ন কানের অধিকারী হতে পারে!’ (সুরা হজ : আয়াত ৪৬)

ইরানের বিখ্যাত কবি শেখ সাদি রহ. বলেছেন, ‘পৃথিবীতে দুই ব্যক্তি সবচেয়ে বড় জ্ঞানী- ভাবুক বা চিন্তাশীল এবং দেশ ভ্রমণকারী।’

আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীজুড়ে তাঁর সুন্দর প্রকৃতি সৃষ্টি করে রেখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বিছানাস্বরূপ অন্তহীন জমিন, সামিয়ানাস্বরূপ খুঁটিহীন আকাশ, পৃথিবীর পেরেক উঁচু উঁচু পাহাড়, নানান বর্ণ ও স্বাদের পানিভরা সাগর-নদী-ঝরনাধারা, জমিনভরা শহর-নগর-গ্রাম, দালান-কোঠা-বাড়ি-ঘর, নানান জাতের গাছ-গাছালি, ফুল-ফসল ইত্যাদি। এসব দেখে মহান স্রষ্টা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালাকে তো দেখা যায় না! পবিত্র কোরআনে আল্লাহর সৃষ্টিরাজি দেখেই তাঁর পরিচয় জানতে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসুল) আপনি বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। এরপর আল্লাহ আবার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ২০)

বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছেন, ‘ভ্রমণ স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্য জানায়, ভ্রমণ আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। প্রত্যেক মানুষেরই সাধ্যমতো কাছে কিংবা দূরে ভ্রমণের মাধ্যমে স্রষ্টার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিকে দেখে অন্তরকে বিকশিত করা উচিত।’

এ ছাড়া ভ্রমণ একটি আনন্দময় ইবাদতও। ভ্রমণকালীন ইসলামের বিশেষ কিছু বিধানের দিকে তাকালে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। আল্লাহ তায়ালা ভ্রমণের সময় নামাজ এবং রোজার ব্যাপারে বিশেষ ছাড় দিয়েছেন। চার রাকাত-বিশিষ্ট ফরজ নামাজে দুই রাকাত মাফ করেছেন এবং সুন্নাত নামাজ ইচ্ছাধীন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তোমরা ভ্রমণে থাক, তখন নামাজ সংক্ষেপ করলে কোনো দোষ নেই।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১০১)

ভ্রমণের কারণে রমজানের রোজা অন্য সময়ে রাখার সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় অথবা ভ্রমণে থাকে, তাহলে সে যেন অন্য সময়ে রোজাগুলো পূর্ণ করে নেয়।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৪)

ইসলামে ভ্রমণের কিছু নীতিমালা রয়েছে। অবৈধ কাজের জন্য ভ্রমণ করতে ইসলাম অনুমতি দেয় না। ভ্রমণকালে সচ্চরিত্রবান উত্তম সঙ্গী নির্বাচন করতে হয়, যে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনে সহযোগী হবে। অবৈধ ও গর্হিত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হয়। আর ভ্রমণসঙ্গীদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি খেয়াল রাখতে হয়, যেন নিজের কোনো আচরণে কেউ কষ্ট না পায়। সর্বোপরি দর্শনীয় স্থানসমূহ দেখে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে হয়। কাফেলার মধ্য থেকে একজনকে আমির বা নেতা মনোনীত করে নেওয়া ইসলামের বিধান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন একসঙ্গে তিনজন ভ্রমণে বের হবে তখন একজনকে আমির [নেতা] নিযুক্ত করবে। (আবু দাউদ : হাদিস ২২৪১)

আর ইসলামে একাকী ভ্রমণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘একাকী ভ্রমণ করার ক্ষতি সম্পর্কে যদি মানুষ জানতে পারত যা আমি জানি, তাহলে কেউই রাতে একাকী ভ্রমণ করত না। (বুখারি : হাদিস ২৭৭)

নারীদের জন্য যাদের সঙ্গে বিয়ে চলে না- এমন মাহরাম পুরুষ ছাড়া ভ্রমণ করা বৈধ নয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘একজন পরপুরুষ একজন নারীর সঙ্গে কোনো মাহরাম ছাড়া একাকী হতে পারবে না এবং কোনো নারী মাহরাম ছাড়া ভ্রমণ করতে পারবে না। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার স্ত্রী হজ করতে যাচ্ছেন, আর আমি অমুক যুদ্ধে নাম লিখিয়েছি। (এখন আমি কী করব?) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি ফিরে যাও এবং তোমার স্ত্রীর সঙ্গে হজ করো। (মুসলমি : হাদিস ২২৯১)

এখন ভাবনার বিষয় হলো, ইসলাম হজের মতো একটি ফরজ ইবাদতেও নারীকে মাহরাম পুরুষ ছাড়া যাওয়ার অনুমতি দেয় না, তাহলে জাগতিক অন্যান্য ভ্রমণে নারীদের মাহরাম ছাড়া বের হওয়া কিভাবে বৈধ হবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, সংগঠন ইত্যাদি থেকে যেভাবে বেগানা নারী-পুরুষ এবং প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পিকনিকে যায় এবং গান-বাজনা-নাচানাচি করে তা ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের দেওয়া বিধান মেনে ভ্রমণ করে আনন্দ ও শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি আমরা পেতে পারি অনেক সওয়াব।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়