ঢাকা     বুধবার   ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ||  মাঘ ১ ১৪৩১

বডি শেমিং কারা করে, কেনো করে?

হৃদয় তালুকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ৩১ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ১১:১৯, ৩১ আগস্ট ২০২৪
বডি শেমিং কারা করে, কেনো করে?

ছবি: প্রতীকী

শরীর নিয়ে কটুক্তি করাকে বডি শেমিং বলা হয়ে থাকে। বডি শেমিং শুধুমাত্র ‘আঘাতমূলক’ একটি শব্দ নয় এর চেয়েও বেশি কিছু। 

সোমা (ছদ্মনাম) অনেকদিন থেকেই তার হাঁপানির সমস্যার জন্য স্টেরয়েড ইনহেলার নিচ্ছেন তাই আস্তে আস্তে মুটিয়ে যাচ্ছেন। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে তার আত্মীয়-স্বজনরা বলে ‘ওমা তুমিতো আগে বেশ সুন্দর ছিলে এখন মোটা হয়ে গেলে কেন? একদমই ভালো দেখায় না’।– এসব মন্তব্য শোনার পরে সোমা বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেন। এমন পরিস্থিতে মানুষ নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিতে চায়, আত্মবিশ্বাস কমে আসে এমনকি মানুষের প্রতি সহানুভূতিও কমে যেতে পারে।

বডি শেমিং কারা করে, কেনো করে, এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায় নিয়ে রাইজিংবিডির সাথে কথা বলেছেন জাতীয় মানসিক সাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেসিডেন্ট ডা. তানজিরা বিনতে আজাদ।

১. আত্মবিশ্বাসের অভাব: যারা নিজের শরীর নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন তারা অন্যদের শরীর নিয়ে কটাক্ষ করে নিজেদেরকে ভালো মনে করার চেষ্টা করেন। এটা তাদেরকে মানসিক প্রশান্তি দেয়।

২. সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মানদণ্ড: সমাজ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সৌন্দর্যের মানদণ্ড প্রকাশ করে । কেউ যদি এই মানদণ্ডের সাথে না মেলে , তবে তাকে উপহাস বা সমালোচনা করা হয়।

৩. সহানুভূতি এবং কাণ্ডজ্ঞানের অভাব: কিছু মানুষ অন্যদের শরীর নিয়ে বিদ্রূপ করে এমনভাবে যে তারা বুঝতে পারে না এসব কথা আরেকজনের মনে কতটা নেতিবাচক প্রভাব পরতে পারে।

৪. পর্যবেক্ষণমূলক শিক্ষা: মানুষ মাত্রই দেখে শিখে।মানুষ তার চারপাশের মানুষ এবং পরিবেশ থেকে অনেক আচরণ এবং মনোভাব শেখে। যদি তারা এমন একটি পরিবেশে বড় হয় যেখানে ‘বডি শেমিং’ স্বাভাবিক, তারা সেই আচরণগুলোকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে নেয়।

৫. স্মার্টনেস এবং প্রভাব বিস্তারের একটি পদ্ধতি: অনেকের জন্য ‘বডি শেমিং’ এক ধরণের বুলিং, যা অন্যকে ছোট করে নিজেকে স্মার্ট এবং ক্ষমতাশালী দেখানোর একটি পদ্ধতি। এটি তাদের দুর্বলতাগুলো আড়াল করার একটি উপায়ও হতে পারে।

৬. কৌতুক করার জন্য: কিছু মানুষ ভুলভাবে মজা করার বা সঙ্গীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অন্যদের শরীর নিয়ে হাসাহাসি করে। তারা ভাবে এটা ক্ষতিহীন ঠাট্টা কিন্তু এতে যে অপর মানুষের মনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরতে পারে, তা তারা বুঝতেই পারে না ।

ডা. তানজিরা বিনতে আজাদ বডি শেমিংয়ের দীর্ঘমেয়াদি কুফল সম্পর্কে বলেন, অনেকদিন ধরে যদি কেউ বডি শেমিংয়ের শিকার হয় তাহলে এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলরূপে বিভিন্ন রকমের মানসিক, আবেগিক, এবং শারীরিক সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন—

১. আত্মসম্মানের অভাব: বডি শেমিংয়ের শিকার ব্যক্তিরা নিজেদেরকে তুচ্ছ মনে করতে শুরু করে। তারা বিশ্বাস করতে পারে যে তাদের মূল্য শুধুমাত্র তাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের ওপর নির্ভর করে।

২. মানসিক অসুস্থতা: বডি শেমিং বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে জড়িত যেমন বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং ইটিং ডিসর্ডার (যেমন- Anorexia nervosa, Bulimia nervosa )। এটি Body dysmorphic disorder (BDD)-এর কারণ হতে পারে, যেখানে ব্যক্তি তার চেহারার তথাকথিত খুঁত নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত থাকে।

৩. সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকা: যারা বডি শেমিংয়ের শিকার হন, তারা প্রায়ই লজ্জা বা অপ্রস্তুত বোধ করেন, যার ফলে তারা জনসমাগম  অথবা এমন কার্যকলাপ এড়িয়ে চলেন যেখানে তাদের শরীর বিচার করা হতে পারে। এর ফলে নিঃসঙ্গতা তৈরি হয়।

৪. শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব: বডি শেমিংয়ের কারণে সৃষ্ট মানসিক চাপ অস্বাভাবিক আচরণ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন অতিরিক্ত খাওয়া, সীমিত খাওয়া, অতিরিক্ত ব্যায়াম করা, এমন কোনো ওষুধ খাওয়া যা শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি তারা প্লাস্টিক সার্জারির শরণাপন্নও হতে পারেন।

৫. দৈনন্দিন কাজকর্মে আগ্রহের অভাব: বডি শেমিং মানুষের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে, যা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে এবং জীবনমানের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

বডি শেমিং বন্ধ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন,  বডি শেমিং বন্ধ করার জন্য ব্যক্তিগত , সামাজিক, এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেমন—

১. সচেতনতা বৃদ্ধি: বডি পজিটিভিটি প্রচার করা এবং বডি শেমিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে জানানো।

২. সহায়তামূলক ব্যবস্থা: ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কাউন্সেলিং, থেরাপি, এবং সাপোর্ট গ্রুপের ব্যবস্থা করা।

৩. সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার: অবাস্তব সৌন্দর্যের মানদণ্ড সম্পর্কে সমালোচনা করা এবং বডি পজিটিভ কনটেন্ট বানাতে উৎসাহিত করা।

৪. নীতিমালা তৈরি: বডি শেমিং রোধে স্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করা এবং শরীরের বৈচিত্র্য গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে সচেতন করা।

৫. আত্ম-সহানুভূতি তৈরি করা: মাইন্ডফুলনেসের মতো অনুশীলনকে উৎসাহিত করা এবং চেহারার চেয়ে ব্যক্তিগত সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেয়া সম্পর্কে উৎসাহিত করা। অন্যদের অবস্থানে নিজেকে রেখে কল্পনা করতে ভাবতে শেখানো এবং সহানুভূতিশীল হওয়া।

৬. অভিভাবকের ভূমিকা: শিশুদেরকে দেহের বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে শেখানো এবং পিতামাতার আচরণে পরিবর্তন আনা।

সম্মিলিতভাবে সঠিক সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে বডি শেমিংএর  ক্ষতিকর প্রভাব রোধ করা স্বম্ভব।

লিপি


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়