ঢাকা     শনিবার   ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১৫ ১৪৩১

আমার দেখা ৭ মার্চ

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ৭ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১২:০১, ৭ মার্চ ২০২১
আমার দেখা ৭ মার্চ

৭০’র নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভের পরও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা করছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।

১ মার্চ বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের ৩ মার্চের অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার মাধ্যমে তিনি অখণ্ড পাকিস্তান টুকরো করার প্রক্রিয়ায় শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন। তার এ ঘোষণা জলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মত কাজ করলো। উত্তাল বাংলা আরো মারমুখী হয়ে ওঠে। সবাই অপেক্ষা করছেন তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিব কি নির্দেশনা দেন।

আমার তখন মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছিল। আমাদের মির্জাপুর সদয় কৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক অমীয় চক্রবর্তী একসময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। সম্ভবত সা’দত কলেজ ছাত্র সংসদেও তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের সময়ে মুসলিম সরকার সমর্থিত কুখ্যাত পেটোয়া বাহিনী ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্ট (এনএসএফ)-এর কিছু গুণ্ডা সা’দত কলেজে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য ভর্তি হন।  রাতের অন্ধকারে তারা ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর হামলা করলে তাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেওয়া হয়। এদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি পরবর্তীতে চিত্রনায়ক হয়েছিলেন। তার নাম ওয়াসিম। তার পারিবারিক নাম মেজবাহ উদ্দিন ছিল। সেই ঘটনায় অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমার শিক্ষক অমীয় চক্রবর্তীকেও মামলা কাঁধে নিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে।

ঢাকায় হরতাল চলছে।  এরমধ্যেও ৬ মার্চ অনেক কষ্টে অমীয় স্যারের সঙ্গে ঢাকা পৌঁছাই। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। সবার গন্তব্য ৭ মার্চের জনসভায় যোগ দেওয়া। সে সময় আমার মামাত বোনের স্বামী আব্দুল বারী খান পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তার সরকারি বাসা ছিল মিন্টু রোডের ব্যাংক কলোনি। রাতে সেখানে উঠি। স্যার অবশ্য ইস্কাটনে তার এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। তার সঙ্গে কথা হয় সকালে আমি গেটে থাকবো, তিনি আমাকে নিয়ে সভাস্থলে যাবেন।

সময়মত স্যার এলেন। বোনের বাসা থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশদিয়ে শাহবাগ হয়ে রেসকোর্স ময়দানে যাওয়া সম্ভব হলো না। লোকে লোকারণ্য। ঘুরে বেইলি রোড হয়ে অনেক কষ্টে বর্তমান কাকরাইল মসজিদের কাছে পৌঁছলাম। এরপরে আর যেতে পারছিলাম না। এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট পর্যন্ত যেতে অনেক সময় লেগে গেলো। ভীড়ের মধ্যে স্যারকে হারিয়ে ফেলি। মানুষের ধাক্কায় কে কোথায় যাচ্ছে বোঝার উপায় ছিল না। স্যার আমাকে একটি জায়গা দেখিয়ে বলেছিলেন, ভীড়ে হারিয়ে গেলে এখানে এসে দাঁড়াবি। অনেক পরে সেখানে স্যারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন জীবন ফিরে পেলাম।

আমাদের পাশেই কয়েকজন প্রৌঢ় ব্যক্তিকে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তার কোথা থেকে এসেছেন। একজন উত্তর দিলেন তারা সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছেন। দু’দিন আগে রওয়ানা হয়েছেন ঢাকার অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য। সে সময় সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকা আসা এতটা সহজ ছিল না। এভাবেই হাজার হাজার মুক্তিকামি মানুষ সেদিন ঢাকায় সমবেত হয়েছিলেন।

৭ মার্চের ভাষণ শুনতে আসা মানুষের ঢল নেমেছিল সেদিন। ময়দানে তিল ধারণের স্থান ছিল না।  কারওয়ান বাজার, নিউ মার্কেট, পলাশি, লালবাগ, গুলিস্তান, মতিঝিল, কাকরাইল এমনকি কমলাপুর রেল স্টেশন, সদরঘাট পর্যন্ত লোক আর লোক। সভা শেষে লোকসমাগম থেকে মুক্ত হতে ঢাকায়ও দুই থেকে তিনদিন লেগে গিয়েছিল।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জনসমাগম বাড়ছিল। পুরো ঢাকা শহর মানুষের স্রোতে উত্তাল। হাতের কাছে যে যা পেয়েছেন তা নিয়েই প্রিয় নেতার মুখ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে এসেছেন। 

বাঙালি জাতির মুক্তির নির্দেশিত দিন ৭ মার্চ, ১৯৭১। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গগণ বিদারী স্লোগান ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘রাওয়ালপিন্ডি না ঢাকা-ঢাকা ঢাকা’। বঙ্গবন্ধু স্টেজে উঠেই সবাইকে শান্ত হতে নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে পিনপতন নিস্তব্ধতায় তিনি বলে উঠেন, ‘অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে আজ আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছি।’

বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বললেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- জয় বাংলা’। পুরো রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনগণ হাত তুলে সমস্বরে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে তার নির্দেশনাকে সমর্থন দিয়ে যে যার ঘরের দিকে রওয়ানা হন।

বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন সে সময় জানা যায়, রেডিও-টেলিভিশন থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো রেসকোর্স ময়দান উত্তেজিত হয়ে উঠে। বক্তৃতা সম্প্রচার না করলে কোন বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন রেডিও-টেলিভিশনে না যান তার নির্দেশনা দেন বঙ্গবন্ধু। 

মূলতঃ সেদিন থেকেই পুরো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। সব কিছু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় চলতে থাকে। 

সভা শেষে অন্যান্যদের মত আমরাও বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। কিন্তু সবকিছু যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। তখন ফুলবাড়িয়া থেকে টাঙ্গাইলের বাস ছাড়তো। সেখানে গিয়ে কোন যানবাহন না পেয়ে হেঁটে টঙ্গী পর্যন্ত যাই। পুরো পথে মিছিলে মিছিলে সয়লাব। সবার মুখে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ আর ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগান। সেখান থেকে একটি ট্রাকে উঠে রাত ২ টায় বাড়ি পৌঁছি।

এরপর থেকে ২৫ মার্চের রাত পর্যন্ত নানা টালবাহানায় সময়ক্ষেপণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা বাহিনীর সদস্য আর আগ্নেয়াস্ত্র সমাগম করা হয়। সেদিনই রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত বাঙালী জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকেও তার ধানমন্ডি বাসা থেকে  গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। বাঙালী সেনা সদস্য, ইপিআর, পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও সে রাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের সেরা সেনা বাহিনীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর বাঙালী জাতির দীর্ঘদিনের স্বাধীনতার স্বাদ পূর্ণতা লাভ করে।

ঢাকা/হাসনাত/টিপু


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়