শোক এখন শক্তির অনির্বাণ উৎস
বঙ্গমৃত্তিকায় যেসব মহান পুরুষ জন্ম নিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান তাদের অগ্রগণ্য। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তান শেখ মুজিব। তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা। তাঁর দূরদর্শী ও ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে একটি পরাধীন জাতি পায় স্বাধীনতার স্বাদ। বহু বছরের শোষণ-দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে তিনি গড়ে তোলেন সমৃদ্ধিশালী, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।
একটি অবহেলিত ভূখণ্ডের ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা অর্জন করার মতো নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিরল নেতা। শেখ মুজিব প্রজাপ্রেমী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। যে মানুষটি কখনোই বাঙালিকে অবিশ্বাস করেননি, শত্রু ভাবেননি, সেই শুদ্ধ চিত্তের মানুষটিকেই কতিপয় স্বার্থপর-ঘাতক বাঙালি সপরিবারে হত্যা করল- যা শুধু বাঙালির ইতিহাসেই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও একটি কলঙ্কজনক ঘটনা বলে বিবেচিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড শুধু একটি হত্যাকাণ্ডই নয়, একটি স্বাধীন, অসাম্প্রদায়িক জাতিকে পরাধীন ও সাম্প্রদায়িক করার পাশবিক চক্রান্তও বটে।
আমরা যদি মুজিব হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রগুলো বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো- একটি স্বাধীন জাতিকে মূলত তারাই ধ্বংস করতে চায় যারা সাম্রাজ্যবাদের পূজারী বা সাম্রাজ্যবাদের মদদদাতা। সুতরাং যারা সাম্রাজ্যবাদী এবং যারা সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক তারাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারী হতে হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারী সবাই অপরাধী, সবাই মুজিব-হন্তারক।
শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ থমকে গিয়েছিল। বজ্রাহত মানুষের মতো অসাড় হয়ে গিয়েছিল বাংলার শোকাহত মানুষ। ঘনিষ্ঠ স্বজন মারা গেলে মানুষ যেমন বাকরুদ্ধ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, শেখ মুজিব হত্যার ঘটনায়ও বাঙালি জাতি শোকে-দুঃখে পাথর হয়ে গিয়েছিল। মানুষ এখন সেই অবশ মুহূর্তগুলোর কথা ভুলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করছেন, তাঁর নামে স্তুতি-স্তব করছেন, এটাই এখন ইতিহাস।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একটি কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। এদিন কেবল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি, মুজিবপত্নী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, পুত্র-পুত্রবধূসহ গোটা পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়। কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিব নিহত হননি। আবার কেবল ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধি বা ব্যক্তিগত আক্রোশ নয়, এর সঙ্গে জড়িত ছিলো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা। এই চক্র এখনও সক্রিয়। তা আমরা প্রতিনিয়তই বুঝতে পারছি।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগের দিন ঢাকা শহরে বাস-ট্রাকে আগুন, ব্যাপক ভাঙচুর ও নাশকতামূলক তৎপরতায় মানুষের মনে সে কথাই ধ্বনিত হয়েছে। বিএনপি যে-আবরণেই তার তৎপরতা চালাক না কেন, জনগণ ঠিকই তাদের নাশকতামূলক তৎপরতা ধরে ফেলেছে। এ কাজ করে তারা তাদের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে নির্মম এবং নৃশংস। দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীরা সদম্ভে ঘোষণা করেছে এ খুনের দায়-দায়িত্বের কথা। তবুও এই ঐতিহাসিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ ছিলো দীর্ঘ একুশ বছর। কেননা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হলে অনেকের মুখোশ খুলে যেতো, তাই তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে দেশের প্রচলিত আইন। আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে পেরেছিল কিনা দেশবাসী আজ ঘাতকচক্র ও তাদের মদদদাতাদের কাছে জবাব চায়। জনগণ এও জানতে চায়, এই হত্যাকাণ্ডের ফলে দেশকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো কেন?
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘দি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স ১৯৭৫’ জারি হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর জাতীয় সংসদে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এই কালো অধ্যাদেশ বাতিল করে জাতির জনক, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় নিহত জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ সব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার বাধা অপসারিত হয়। পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক দুঃশাসনের কালে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেছে। যে মহান ব্যক্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছেন, বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় আদায় করে দিয়েছেন, বাঙালি জাতির একটি নিজস্ব আবাসভূমি এনে দিয়েছেন, সেই ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের বিচার এতো দীর্ঘকাল বন্ধ ছিলো, এ কথা কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষ ভাবতেই পারে না।
বঙ্গবন্ধুর বড় কৃতিত্ব তিনি বাঙালি জাতিসত্তাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন, তবে এর প্রক্রিয়াকরণ চলেছে বহুদিন ধরে। বাঙালির দীর্ঘদিনের আত্মানুসন্ধান, আন্দোলন ও সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। আজকের বাংলাদেশ যা এক সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিলো, সেই সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই শেখ মুজিব ‘পূর্ববঙ্গ’কে ‘বাংলাদেশ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। বাংলার রাজনীতিতে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ধারার সূচনা করেন। এদেশের রাজনীতির মধ্যযুগীয় সাম্প্রদায়িক ধারাটিকে ভেঙে দেন তিনি। ‘মুসলিম’ লীগ থেকে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে নিয়ে গঠন করেন আওয়ামী লীগ।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ক্রমবিকাশের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন শেখ মুজিব। ’৭০-এর দশকে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এমনভাবে সমার্থক হয়ে উঠেছিলো যে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করা যেতো না এবং এ সময় মানুষের মধ্যে বাঙালি চেতনাবোধ ও স্বদেশপ্রেমের এক অভূতপূর্ব স্ফূরণ ঘটেছিলো।
বাংলার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টান সবাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হয়েছিলো। ১৯৭১ এর-৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত আহ্বান। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। একাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ গঠনের পথ সুগম করার অপরাধে পাক-সামরিক সরকার তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। কিন্তু বিশ্বজনমতের চাপে তারা তা কার্যকর করতে পারেনি। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পাকিস্তানের যেসব দেশি-বিদেশি দোসর মেনে নিতে পারেনি তারা বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে। ইয়াহিয়া ভুট্টোর দোসর এবং জামায়াতের আলবদর বাহিনীর সমর্থকরা নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে। নানা বাধা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা স্থিতিশীলতার দিকে নেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য ছিল। সোনা-রূপা, টাকা-পয়সা-অবকাঠামো কিছুই সেদিন ছিল না। বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতায় স্বল্পতম সময়ের মধ্যে শ্মশান বাংলাকে স্বনির্ভর বাংলাদেশে পরিণত করেন। ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে তিনি এ কথাই প্রমাণ করেছিলেন, সদিচ্ছা থাকলে শূন্য হাতে যুদ্ধ করেও সফল হওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু যখন সন্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে। তস্করের মতো রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে অগ্রসর হয় কতিপয় বাঙালি ঘাতক। এসব ঘাতকেরা বিদেশি প্রভুদের ইঙ্গিতে এবং এদেশীয় বিশ্বাসঘাতক নরপশুদের সহযোগিতায় ইতিহাসের কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশে পাকিস্তানি ধারা ফিরিয়ে আনা হয়। হত্যাকারীরা বাংলাদেশের সর্বত্র ভয়-ভীতি-সন্ত্রাস প্রতিষ্ঠিত করে এবং দেশপ্রেমিক নেতা-কর্মীদের উপর জেল-জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। হতচকিত জাতি এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে অবস্থান নিতে পারেনি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল নেতৃত্বের কারণে। দলের লড়াকু নেতৃবৃন্দ অধিকাংশ মন্ত্রিসভায় যোগদান করায় দলীয় কাজকর্ম যেন কিছুটা শিথিল হয়ে পড়েছিলো। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তাই তাঁরা কর্মীদের নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হতে পারেননি। যাঁরা গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন সেসব প্রথম সারির নেতারাও কেন যেন নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রশ্ন জাগে, নিরপরাধ বঙ্গবন্ধু কাদের নিয়ে দল গঠন করেছিলেন যাঁরা দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের জন্য করণীয় কর্তব্য পালন করতে পারেননি? ওই সময়ের আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না-করার ব্যর্থতার দায় কিছুতেই এড়াতে পারেন না।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌলার পরাজয় এবং তাঁর হত্যাকাণ্ড যেমন ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়েছিলো আমাদের, তেমনি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডে আমরা পিছিয়ে যাই এবং দেশ আবার উল্টোমুখে ফিরে যায় পাকিস্তানি ধারায়। এতে পাকিস্তানিরা এবং দেশীয় ধর্ম ব্যবসায়ী ও ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা উল্লসিত হয়। মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মকে টেনে আনা হয় রাজনীতিতে, সংস্কৃতি ও জীবনমান উন্নয়নসহ সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ। জেল জুলুম অত্যাচারের ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায় অনেক নেতা-কর্মী। যে বঙ্গবন্ধু নামের বীজমন্ত্রে বাংলাদেশ উদ্বেলিত ছিল, সেই নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো।
বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যিশু খ্রিস্টের হত্যাকাণ্ডের একটি অদ্ভুত মিল আছে। মানুষের মুক্তির কথা বলতে গিয়ে ঘনিষ্ঠ সহচরদের ষড়যন্ত্রে ক্রুশবিদ্ধ হন যিশু। যিশুর মৃত্যুর পরে দীর্ঘদিন তার নাম উচ্চারণ করা যায়নি, অথচ আজ সমগ্র বিশ্বে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সর্বাধিক। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডেও গোপনে হাত মেলায় তার কতিপয় সহযোদ্ধা। তারাও দীর্ঘকাল বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের চার বছর পরে ১৯৭৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে শোক পালন করা হয়। ১৯৭৯ সালে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করে আমরা শোকসভা করি। প্রকাশ করি- ‘বাংলাদেশের সমাজ বিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন’, ‘রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি’ ও ‘বাঙালির কণ্ঠ’-এর মতো কালজয়ী গ্রন্থ। যিশুর মানব মুক্তির বাণী ও আদর্শকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছে বিশ্ববাসী, তেমনি বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত রাজনৈতিক মতবাদ ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ও একদিন মানবিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে পৃথিবীজুড়ে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেমে আসে মহাবিপর্যয়। স্বনির্ভর, সমৃদ্ধ অর্থনীতির যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, তা পরিণত হয় মরীচিকায়। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বলে পরিচিত বাংলাদেশ পরিণত হয় স্থায়ী খাদ্য ঘাটতির দেশে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষণ্ন হয়। এই দুঃসহ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের জনগণকে টানা একুশ বছর সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। অসংখ্য সংগ্রামী জনতার রক্ত ঝরেছে বাংলার মাটিতে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতার ধারায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক এবং তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের হত্যা এবং আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মীদের ওপর নির্মম দমননীতির মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে দুর্বল করে ফেলা হয়। শেখ হাসিনার দূরদর্শী, সাহসী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্রুত পুনর্গঠিত হয়। জনগণ ফিরে পায় ভোটাধিকার। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন এই অধিকার প্রয়োগ করে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে আওয়ামী লীগকে। পাকিস্তানি ধারার পরিবর্তে দেশ পুনরায় এগিয়ে চলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারায়। অর্থনীতি ফিরে পায় গতিশীলতা। তলাবিহীন ঝুড়ি আর ভিখারীর দেশের অপবাদ ঘুঁচিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল।
বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরী হিসেবে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। শক্র-মিত্র চিনতে হবে তাকে। কেউ যেন বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে সুবিধা আদায় না করতে পারে এ দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি সম্মানার্থে কর্মীদের উচিত তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো নিপুণভাবে সম্পন্ন করা। দেশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের কাঁধে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে এখনও অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হবে। এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন সহজ ব্যাপার নয়, অনেক কঠিন। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে কাজ করে যেতে হবে। এদেশকে একবিংশ শতাব্দীর যোগ্য করে গড়ে তুলে ধরতে হবে।
বঙ্গবন্ধু আজ ‘বিশ্ববন্ধু’ হয়ে উঠেছেন। তার নামে ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন তিনি। শান্তিকামী বঙ্গবন্ধু শান্তির স্বপক্ষে লড়াই করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বঙ্গবন্ধুর নামে ইউনেস্কো ঘোষিত শান্তি পদক বাঙালি জাতিকে নতুন গৌরব দান করেছে। বিশ্বে এখন মহাসমারোহে উদযাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। করোনা-মহামারীর কারণে আনুষ্ঠানিকতায় কিছুটা ধীর গতি এলেও মানুষের অন্তরে বঙ্গবন্ধু আজ অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ১৫ আগস্ট বাঙালির জন্য এখন শুধু আর শোকের মুহূর্ত নয়, শোক এখন পরিণত হয়েছে শক্তির অনির্বাণ উৎসবিন্দুতে। নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। জাতীয় শোক দিবসে পঁচাত্তর ট্র্যাজেডির শহীদদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ
ঢাকা/তারা