নজরুল-নিরূপম
অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার
সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকার নজরুল এত অতি-আলোচিত যে কবিশিল্পী নজরুল এর ভিড়ে হারিয়ে গেছে প্রায়। অভিনিবেশি পাঠে টের পাই- রণরোলের যে কণ্ঠ বেজে ওঠে সমাজ-রাজনৈতিক পরিসরে; প্রেমের ক্ষেত্রে তা যেন বিধুর আত্মার উচ্চারণময়। রৌদ্রদগ্ধের গানের মতোই তিনি বলে উঠেন, ‘হে আমার ব্যথা, তোমাকে নমস্কার’। এই ব্যথার দানেই নজরুলে অনন্য নন্দনসূত্র নিহিত।
২
এই পোড়া দেশ! শিশু বয়সেই মানুষকে শেখানো হয় এখানে সাদা আর কালো পিঁপড়ার ভেদ। শেখানো হয় ঠাকুরটা হিন্দুদের, নজরুল আমাদের। স্কুল-কলেজে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টাররাও বলে শুনেছি ‘বজ্জাত’ ঠাকুরই নজরুলকে পাগল বানিয়ে ফেলেছিল যেন সে নোবেল না পায়। হায়রে দেবালয়বাসী ভণ্ড! যদি জানতে বসন্ত চিরদিন স্বাগত জানায় নববসন্তকে। যদি জানতে বিধর্মী ঠাকুর নজরুলকে ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছিল যখন সে নেহায়েত তরুণ যুবা। কেউ কেউ উষ্মা প্রকাশ করলে বসন্তকার বলল, ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল।’ পাগল বলেই রবি খোলামেলা ভালোবেসেছিল আরেক পাগল কাজী কবিকে। তোমাদের মতো সুস্থ-মস্তিষ্কের স্বজাতীয় হলে হয়ত তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে গোলাম মোস্তফার ঢঙে লিখত রাশি রাশি ব্যঙ্গ-পদ্য।
৩
আজকের সাহিত্যতত্ত্বে বিচার করলে নজরুল সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা-প্রত্যালোচনাও জরুরি। কলেজকৈশোরে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্টের ‘Tree at my Window’ কবিতার সঙ্গে নজরুলের বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি কবিতার আশ্চর্য মিল-প্রতিমিল আবিষ্কার করে বিস্মিত হয়েছিলাম। এভাবে নজরুল সাহিত্য বৃহত্তর প্রেক্ষিতে তুলনামূলক আলোচনায় প্রতিস্থাপন করলে আমাদের সাহিত্য সমালোচনা আরো সুপ্রসর হবে বলে মনে করি।
৪
নজরুলি রসিকতাও উল্লেখ করার মতো। সম্প্রতি কলকাতা ঘুরতে গিয়ে কফি হাউসে লাঞ্চ শেষে প্রেসিডেন্সি কলেজে চক্কর মারতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কবিবন্ধু জিয়া হক জিজ্ঞেস করলো- পান খাবো কি না?
আমি মজা করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি পানাসক্ত?’
আমার উপর দ্বিগুণ মজা নিয়ে জিয়া বলল, ‘হ্যাঁ একটু বেশ্যাসক্ত!’ পরক্ষণেই আমার অবাক হওয়া দেখে সে বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই। এই শব্দবন্ধটা আমার নয়, নজরুলের। বেশি + আসক্ত = বেশ্যাসক্ত। অর্থাৎ আমি একটু বেশি পরিমাণ পানে আসক্ত।’
নজরুলের নির্মল ও দ্বীপ্ত রসবোধের একটা জানালা হাট করে খুলে গেল সমুখে আমার।
৫
ড. আহমদ শরীফ যে ‘নজরুল অহিফেন’ এর কথা বলেছিলেন; পাকিস্তানি জামানা থেকে এই এখন পর্যন্ত তা সক্রিয় এবং নজরুলের নাম করে সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী কালচার বিজনেস এভাবে চলছে। যেন চলেই যাবে। তাই নজরুল নিয়ে রচিত উদ্দেশ্যভারাতুর রচনার সতর্ক পাঠের পাশাপাশি ব্যক্তি নজরুলকে ভক্তিবাদী আবরণমুক্ত মানুষ নজরুল হিসেবে আবিষ্কার করতে হলে, তার মোহমুক্ত জীবনী নির্মাণ করতে গেলে নজরুল-সমসাময়িকদের স্মৃতিকথার উপর নির্ভর করতে হবে। যেখানে সমকালীন উপযোগবাদের কাঠামোয় নয় বরং স্মৃতির স্বচ্ছ আলোয় ধরা পড়ে অন্তরালের কবিমানুষটি।
৬
নজরুল বিষয়ক সব প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও সামগ্রিক নজরুল চর্যায় এখনও প্রাধান্য দেখা যায় বিশিষ্ট প্রবীণদের। তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, একজন কবি বেঁচে থাকেন তার ক্রমব্যাপ্ত উত্তরপ্রজন্মের পাঠ ও মূল্যায়ন-পরম্পরায়। তাই নজরুলকে নিয়ে এখনকার সক্রিয় কবি লেখকরা কী ভাবছে, বিশেষত তার সাহিত্যবিশ্ব নিয়ে তরুণদের চিন্তারেখার উন্মোচনে নজরুলচর্চা সাম্প্রতিক সাহিত্যবলয়ের সঙ্গে যুক্ততা পাবে। জীবনানন্দ দাশ যেমন বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণে অন্বেষণ করেছেন নজরুলের বর্ণময় কবিসত্তা তেমনি আমাদের আজকের তরুণ কোনো কবির হাতেই হয়তো উন্মোচিত হবে নজরুল সাহিত্যের না খোলা সব গিঁট।
৭
ভাষাশিল্পী নজরুলও আমাদের অন্যতম আলোচ্য হওয়া উচিত। বাংলা ভাষাভ্যন্তরে যুগপৎ যে শক্তি ও লাবণ্যরসের অভূত বেণীবন্ধন ঘটিয়েছেন নজরুল, তার স্বরূপ উদ্ঘাটন হওয়া জরুরি। বাংলা ভাষার প্রয়োগ সম্ভাবনা নজরুলের লেখার মধ্য দিয়ে নানাভাবে সাকার হয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বলবন্ত ও কোমল এ ভাষারীতি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নয় বরং তার নিজস্ব নির্মিতি। নিরীক্ষামূলক এ ভাষা পাঠক সাধারণ যে বিপুল ভালোবাসায় গ্রহণ করে চলেছে তার আন্তঃরসায়নের খোঁজ পাওয়া গেলে শুধু নজরুলের নয়, আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষারও একটি অন্যতর দিগ্বলয় উন্মোচিত হবে।
৮
নজরুলে পাওয়া প্রেম
এ জীবন
অনন্ত আশ্বিন।
সে জলে ভেসে চলে
আমার সমূহ শিউলিমালা।
রিক্ত হয়েও
তার স্রোতস্বিনী সুবাসে
ঐ দেখো
আমার ম্লানগৈরিক রাজবেশ।
এবার নিশ্চয়ই ভাঙবে
বিরহী প্রেমসিন্ধুর
পাষাণ-ঘুম।
ঢাকা/তারা