ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১০ ১৪৩১

কাজী নজরুল ইসলাম : কবি ও সাংবাদিক

বাবলু ভট্টাচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ২৪ মে ২০১৫   আপডেট: ১২:১৪, ২৫ মে ২০২১
কাজী নজরুল ইসলাম : কবি ও সাংবাদিক

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সবার কাছে বিদ্রোহী কবি, গীতিকার ও সুরকার ‍‌হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। একইসঙ্গে তিনি সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষিত শ্রেণী সচেতন অকুতোভয় কবি, প্রবন্ধকার ও সাংবাদিকও ছিলেন।

১৯২০ সালের ১২ জুলাই কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজফ্‌ফর আহমদের যৌথ সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ ঘটলো সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ পত্রিকার। যদিও কাগজে ঐ দু’জনের নাম ছাপা হতো না। নজরুলের জোরালো লেখার গুণেই প্রথম দিন থেকেই কাগজটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল; গ্রহণযোগ্য হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছে! একটি সুস্থ ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনা বিস্তারে এই পত্রিকার অবদান অসামান্য। পত্রিকায় ভাষা ও সংস্কৃতিগত সংগ্রাম এবং ঐক্যের জোয়ার এনেছিলেন নজরুল ও মুজফ্‌ফর আহমদ ‘নবযুগ’ পত্রিকার মাধ্যমে। এই পত্রিকাতেই নজরুলের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি।

খিলাফত আন্দোলনের সময় ভারত থেকে বহু মুসলমান ব্রিটিশনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ স্বেচ্ছানির্বাসনে যান আফগানিস্তানে। এদের বলা হতো মুহাজির বা নির্বাসিত। এই নিরীহ মুহাজিরদের ওপর ব্রিটিশ সৈন্য অকথ্য অত্যাচার করে— নিহত হন বহু মুহাজির। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নজরুল ‘নবযুগ’-এ জোরালো সম্পাদকীয় লেখেন : ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ সংবাদের শিরোনাম রচনাতেও নজরুলের বিশেষত্ব উল্লেখযোগ্য। ইরাকের রাজা ফয়সুলের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সংবাদের শিরোনাম লেখেন রবীন্দ্রনাথের গানের কলি ব্যবহার করে : ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/পরণসখা ফয়সুল হে আমার।’ নবযুগে লেখা নজরুলের অসাধারণ একুশটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ পরে ‘যুগবাণী’ নামে বইয়ের আকারে ছাপা হয়। জনমনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘নবযুগ’ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের ভাবিয়ে তুলেছিল। রাজরোষে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।

ইতোমধ্যে রচিত হয়েছে নজরুলের ইতিহাস সৃষ্টিকারী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র দপ্তরে মুজফ্‌ফর আহমদের সঙ্গে একত্রে বসবাসকালীন একদিন সারারাত জেগে নজরুল লিখে ফেললেন এই কবিতা। কবিতাটির প্রথম শ্রোতা ছিলেন মুজফ্‌ফর। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই বন্ধু মুজফ্‌ফরকে তিনি সদ্য লেখা কবিতাটি পড়ে শোনান। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বাংলা কাব্য সাহিত্যে এক অসাধারণ সৃষ্টি। কবিতাটি বাংলার বিপ্লববাদীদের ঘোষণাপত্রের ভূমিকা পালন করেছে, সবরকম ভীরুতা দীনতা থেকে মুক্ত হয়ে সাহস ও স্পর্ধার সাথে এগিয়ে চলার প্রেরণা জুগিয়েছে।
এই কবিতাটি শোনানোর পরে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ এই দুটি কবিতা সেই যুগে বিপ্লবীদের পাথেয় ছিল।

এরপরের অধ্যায় আরো সংহত চেতনা ও রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে কাগজ প্রকাশের প্রচেষ্টা। সেই রাজনৈতিক লক্ষ্য হলো, দেশের মজুর-কৃষক আপামর জনতার মুক্তির প্রয়োজনে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের সচেতন ও সংগ্রামমুখী করে তোলা। ইতোমধ্যে ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ শহরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে কাগজ চাই। রাজনৈতিক শিক্ষার কাজ সংবাদপত্র ছাড়া হতে পারে না। দেশের অভ্যন্তরে তখন পার্টির কাজ ও পত্রিকা প্রকাশনার কাজ অসম্ভব ও দুঃসাধ্য ছিল। তাই বিদেশ থেকে কাগজ বের করার কথা ভাবা হয়। ১৯২২ সালের ১৫ মে বার্লিন থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুখপত্র প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন এম এন রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায়)। কাগজের নাম ছিল ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব দ্য ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স।’ ক্রমান্বয়ে কৌশলগত কারণে কাগজটির নাম পরিবর্তন করতে হয়। ‘দ্য অ্যাডভ্যান্স গার্ড’ নামে কিছুদিন চলার পরে ‘দ্য মাসেস অব ইন্ডিয়া’ নাম দিয়ে প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে গোপনে পাঠানো হতো বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মীর নামে।

‘ধূমকেতু’ কাগজটিও রাজনৈতিক কাগজ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কাগজের নামকরণ নজরুলেরই। ১৯২২ সালের ১২ অগস্ট নজরুলের একক প্রয়াসে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’। জন্মলগ্নেই ‘ধূমকেতু’ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরলো এবং ঘোষণা করলো পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে। ‘ধূমকেতু’র জন্য নজরুল রবীন্দ্রনাথের কাছে বাণী প্রেরণের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাণী পাঠালেন এই ভাষায় :

‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এ দুর্গ শিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্দ্ধ চেতন’।

‘ধূমকেতু’র ১৩ অক্টোবর ১৯২২ সংখ্যায় ‘ধূমকেতুর পথ’ নামে এক দীর্ঘ সম্পাদকীয় রচনায় নজরুল লিখলেন : ‘...যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করেছেন তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটলি বেঁধে সাগর পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তারা শুনবেন না। ...পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল কিছু নিয়মকানুন বাঁধন শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে...’।

ইতোমধ্যে ৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘ধূমকেতু’র পাতায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ায় শাসক মহলে শোরগোল পড়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, কবিতাটি প্রথমে সদ্য প্রকাশিত ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র পক্ষ থেকে একটি লেখা চেয়ে পাঠানোর অনুরোধ রক্ষায় নজরুল পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু রাজরোষ থেকে সদ্য প্রকাশিত পত্রিকা রক্ষা করার চিন্তা থেকে কবিতাটি তারা ছাপাননি। কবিতাটির ছত্রে ছত্রে ছড়ানো ছিল ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উত্তপ্ত আহ্বান।

‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’

তৎকালীন বাংলাদেশে শ্রমিক-কৃষকের জীবন-যন্ত্রণা চিত্রিত করে ও স্বাধীনতা চেতনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন রকম পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’ তারই পদক্ষেপ। ‘নবযুগ’ পত্রিকার মতো ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাও ছাপা হতো ৩২নং কলেজ স্ট্রিটের ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র দপ্তর থেকে। পত্রিকা প্রকাশের আড়াই মাসের মাথায় ১৯২২ সালের ৬ নভেম্বর সেই দপ্তরে বিরাট পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। আর মুদ্রক-প্রকাশক মুহম্মদ আফজালুল হককে সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করা হলো।

কিন্তু নজরুল তখন এক বিশেষ কাজে চলে গিয়েছিলেন বিহারের সমস্তিপুর। পরে সেখান থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে চলে আসেন পূর্ববঙ্গে। অবশেষে পুলিশ তাঁকে কুমিল্লা শহর থেকে গ্রেফতার করে। বিচারাধীন হিসেবে তাঁকে হুগলী জেলে বন্দী রাখা হয়। কিন্তু স্বভাব বিদ্রোহী দামাল নজরুলকে দমানো সহজ নয়। রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির দাবি এবং জেলের ভিতরে নানা অব্যবস্থার প্রতিবাদে নজরুল অনশন শুরু করেন। এই অনশনের খবরে সারা দেশ সচকিত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ স্নেহভাজন কবিকে তারবার্তা পাঠিয়ে অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে লেখেন : ‘অনশন ত্যাগ করো—আমাদের সাহিত্য তোমাকে চায়’। কবির অনুরোধ ও মাতৃসমা বিরজাসুন্দরী দেবীর অনুরোধে অবশেষে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন। সরকারও বন্দীদের দাবি মেনে নেয়। দশমাস বন্দী জীবন-যাপনের পর নজরুল জেল থেকে ছাড়া পান।

জেল থেকে বেরিয়ে নজরুল নতুন উদ্যমে রাজনৈতিক কাজ ও কবিতা রচনাসহ লেখালেখির কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শুরু হলো আর এক নতুন অধ্যায়। সেই মুহূর্তে নিজের উদ্যোগে কোনো পত্রিকা প্রকাশ না করলেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চলতে থাকলো লেখালেখি। অবশেষে ১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুজফ্‌ফর আহমদ লেবার স্বরাজ পার্টির মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তৎকালীন বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক সংগঠকরা মিলে গড়ে তুলেছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ বা শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল। ‘লাঙল’-এর প্রধান পরিচালক হয়েছিলেন নজরুল এবং সম্পাদক ছিলেন মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। মুদ্রক ও প্রকাশকও মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। প্রথম সংখ্যাতেই নজরুল লিখলেন :

‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
গাহি সাম্যের গান।’

‘লাঙল’ পত্রিকাতেও রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘বলরাম’ আসুক দেশে তার ‘মরুডাঙা দল’ নিয়ে আর যত ‘ব্যর্থ কোলাহল’ ‘স্তব্ধ’ করুক নবজীবন নির্মাণের মধ্য দিয়ে।” ‘লাঙল’-এর প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ছিল জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবিতে। দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশ হয়েছিল ‘কৃষকের গান’। ‘লাঙল’ পত্রিকায় নজরুল সচেতন সাম্যবাদী। এই পর্যায়ে তিনি নিপীড়িত শোষিত শ্রেণীর কথা বলেছেন নিছক আবেগ নির্ভর হয়ে নয়— এক বিশেষ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। এই পর্যায়ে তিনি আরো পরিণত।

বাংলাকাব্যে শ্রেণী সংগ্রামের চেতনা প্রকাশে কাজী নজরুল ইসলাম  অগ্রগামী কবি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পল্টনে থাকাকালীন ১৯১৭ সালে অনুষ্ঠিত রুশ বিপ্লব নজরুল ইসলামের মনে নতুন যুগ সম্বন্ধে ভাবনার স্ফূরণ ঘটিয়েছিল। অনুপ্রাণিত করেছিল শোষণের শৃঙ্খল মোচনের সংগ্রামে এগিয়ে যেতে। এই অনুপ্রেরণায় প্রকাশ তিনি ব্যক্ত করেছেন ‘প্রলয়োল্লাস’ গীতি কবিতায়। রুশ বিপ্লবকে আবাহন জানিয়ে লিখেছেন :

‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখির ঝড়।’

১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে রুশ বিপ্লব সংঘটিত হবার পরে পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী সরকারগুলি রাশিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে ভিতরের প্রতিক্রিয়াশীল-প্রতিবিপ্লবী বাহিনীকে সাহায্য করতে থাকে বিপ্লবকে পরাজিত করা ও শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্যে। সে সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রগামী সদস্যরা বিপ্লবকে রক্ষা করতে শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিকতাবোধ থেকে লালফৌজে যোগ দিয়েছিলেন। একদল ভারতীয়ও মধ্য এশিয়ায় লালফৌজের নেতৃত্বে সংগ্রাম করেছিলেন।
নজরুল তাঁর ‘ব্যথার দান’ গল্পে বাংলা সাহিত্যে প্রথম লালফৌজকে উপস্থিত করেন।

মেহনতী মানুষের মুখপত্র হিসাবে ‘লাঙল’ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ‘লাঙল’ শব্দটি যেহেতু কেবলমাত্র কৃষকদের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত, সেজন্য মুজফ্‌ফর আহমদ এবং তাঁর সহযোদ্ধারা মিলে ঠিক করলেন নামটি পরিবর্তন করা হবে। ১৯২৬ সালের আগস্ট মাসে পত্রিকার নাম পরিবর্তন করে ‘গণবাণী’ করা হলো। সম্পাদক নির্বাচিত হলেন মুজফ্‌ফর আহমদ। বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকদলের মুখপত্র হিসেবেই ‘গণবাণী’র আত্মপ্রকাশ ঘটলো। ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’র সাথে একীভূত হয়ে গেল।

শ্রেণীচেতনা ও সাম্যবাদী আদর্শে ঋদ্ধ নজরুল ‘গণবাণী’র পাতায়ও তাঁর লেখনী নিয়ে সমান দীপ্যমান রইলেন। এই পত্রিকাটিতেই নজরুল ১৯২৭ সালে মে দিবস পালনের প্রাক্কালে ফরাসি শ্রমিক কবি ইউজিন পাতিয়ের রচিত শ্রমজীবীদের আন্তর্জাতিক সংগীত বা ইন্টারন্যাশনাল সংয়ের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন। অনুবাদটির নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত’।

নজরুলের সাম্যবাদী চেতনা পূর্ণ বৈজ্ঞানিক না হলেও মানব ইতিহাসের বৈপ্লবিক বিকাশ সম্পর্কে জাগ্রত ছিল। তিনি যেমন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহার পাঠ করেছেন, পরে আবদুল হালিমের সঙ্গে একত্রে অনুবাদেরও প্রয়াস নিয়েছিলেন, পাঠ করেছিলেন ক্যাপিটাল, ইবসেন, এমিল জোলা, লেনিন, বার্ট্রান্ড রাসেলের বলশেভিসিজম ইন রাশিয়া, আবার একইসঙ্গে পাঠ করেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’। তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তাধারা শক্তি সংগ্রহ করেছে ফরাসি বিপ্লব ও রুশ বিপ্লবের ঐতিহ্য এবং শেলি, হুইটম্যান, গোর্কির সাহিত্য থেকে। স্বাধীনতা প্রীতি ও জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আবেগের সমন্বয়েই নজরুলের সাম্যবাদী চেতনা পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল।

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়