২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পাস
নির্দিষ্টকরণ বিল-২০২১ পাসের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পাস করা হয়েছে। বুধবার (৩০ জুন) স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এ বিল পাস হয়।
এ সময় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন।
অর্থমন্ত্রী ২০২১ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের কার্যাদি নির্বাহের জন্য সংযুক্ত তহবিল হতে অর্থ প্রদান ও নির্দিষ্টকরণের কর্তৃত্ব দেওয়ার জন্য আনিত বিলটি (নির্দিষ্টকরণ বিল-২০২১) পাসের প্রস্তাব করেন। এরপর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বাজেট পাস করার জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি কণ্ঠভোট আহ্বান করেন। সংসদ জুড়ে ‘হ্যাঁ’ শব্দ শোনা যায়। ‘না’ এর পক্ষে কেউ ভোট শোনা যায়নি। এরপর কণ্ঠভোটে পাস হয় ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। আর সরকারি দলের সদস্যদের কণ্ঠভোটে বিরোধী দলের ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো নাকচ হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৩তম বাজেট। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের তৃতীয় বারের মতো বাজেট পেশ করেন। গত ৩ জুন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল সংসদে বাজেট উপস্থাপনের পর মোট ৪০ জন সংসদ সদস্য ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে ১৬ ঘণ্টা ১০ মিনিট আলোচনা করেন। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দিন (১ জুলাই ) থেকে এ বাজেট কার্যকর হবে।
এর আগে ৪১০টি ছাঁটাই প্রস্তাব আসে। দেশের মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৬৯টি দাবির বিপরীতে বিরোধীদল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির ছাঁটাই প্রস্তাব দেন। যেসব সংসদ সদস্য এ প্রস্তাব দিয়েছেন তারা হলেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, পীর ফজলুর রহমান, ফখরুল ইমাম, লিয়াকত হোসেন খোকা, মুজিবুর রহমান (চুন্নু) ও রওশন আরা মান্নান এবং বিএনপির হারুনুর রশীদ।
৬৯টি দাবির মধ্যে সংসদ সচিবালয় এবং লেজিলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগে কোনো ছাঁটাই প্রস্তাব নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একটি করে ছাঁটাই প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের চার থেকে ৯টি করে ছাঁটাই প্রস্তাব রয়েছে।
সংসদের বৈঠকের শুরুতে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জানান, এসব দাবির মধ্যে সময় বিবেচনা করে দুইটির ক্ষেত্রে আলোচনার কথা বলেন।
গত ২ জুন বিকেল ৫টায়এ অধিবেশন শুরু হয়। ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট সংসদে পেশ করেন। এছাড়া ওইদিন তিনি ২০২০-২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটও পেশ করেন। গত ৭ জুন সম্পূরক বাজেট পাস হয়।
এবারের বাজেটের স্লোগান ‘জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার।
উল্লখ্যে, গত ১১ মে সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের (১) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ২ জুন বিকেল ৫টায় অধিবেশন আহ্বান করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
বাজেটে খাতভিত্তিক বরাদ্দ: বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, কৃষি ও কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মানবসম্পদ (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) খাতে ২৯.৪ শতাংশ, সার্বিক কৃষি খাতে (কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান, পানিসম্পদ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) ২১.৭ শতাংশ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ১২.১ শতাংশ, যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে (সড়ক, রেল, সেতু এবং যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) ২৬.৪ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ১০.৪ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে।
বাজেট ঘাটতি: এবারের বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। এই হার গত বাজেটে ছিল ৬.১ শতাংশ। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক উৎস হতে এক লাখ এক হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস হতে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা হতে সংগৃহীত হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক-বহির্ভূত খাত হতে আসবে ৩৭ হাজার এক কোটি টাকা।
ব্যয় হবে যে খাতে: বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সম্পাদিত কাজের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী কাজগুলোকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলো হলো- সামাজিক অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো ও সাধারণ সেবা খাত। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৮.২৫ শতাংশ; এর মধ্যে মানবসম্পদ খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত) বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। ভৌত অবকাঠামো খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বা ২৯.৭৬ শতাংশ; যার মধ্যে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৭৪ হাজার ১০২ কোটি টাকা; যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ৬৯ হাজার ৪৭৪ কোটি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা।
সাধারণ সেবা খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৪.০৪ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি), বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বাবদ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫.৭৪ শতাংশ; সুদ পরিশোধ বাবদ প্রস্তাব করা হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১১.৩৬ শতাংশ; নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয় খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে পাঁচ হাজার ১০৩ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ০.৮৫ শতাংশ।
বিগত এক দশকে বাংলাদেশের ক্রমাগত উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন কোভিড-১৯ এর প্রভাবে সাময়িক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনাভাইরাসের কারণে তা হ্রাস পেয়ে পাঁচ দশমিক দুই শতাংশে দাঁড়ায়। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে কোভিড-১৯ এর প্রভাব হতে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হবে ধরে নিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল আট দশমিক ২০ শতাংশ।
কিন্তু এ মহামারির প্রভাব দীর্ঘতর হওয়া এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ও লকডাউন ঘোষণার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্লথ অবস্থা বিরাজমান রয়েছে। এছাড়া রফতানি ও আমদানির ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত গতি ফিরে পায়নি। তবে প্রবাসী আয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়া এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকার ঘোষিত বৃহৎ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন সংশোধন করে ছয় দশমিক এক শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
পাশাপাশি কোভিড-১৯ পরবর্তী উত্তরণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সময়ে মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। মধ্যমেয়াদে প্রবৃদ্ধির প্রধান উৎস হলো- শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা। অন্যদিকে সরবরাহের দিক থেকে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর মাধ্যমে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে।
আসাদ/সাইফ