হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ সাজা চান আবরারের বাবা-মা
মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার প্রায় ২৬ মাস অতিবাহিত হচ্ছে। সংখ্যার দিক দিয়ে হয়তো সামান্য কটা দিন। কত দ্রুতই না চলে গেলো। অনেকের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে সেই দিনের সেই নির্মমতার চিহ্ন। কিন্তু আবরারের মা-বাবার কাছে প্রতিটি দিনই ছিলো যন্ত্রণাদায়ক। নিদারুণ কষ্ট আর বেদনা বুকে নিয়ে তারা ছেলে হত্যার বিচার দেখার অপেক্ষায়। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান আজ রোববার (২৮ নভেম্বর) মামলাটির রায় ঘোষণা করবেন।
রায়ে আবরারের মা রোকেয়া খাতুন আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করছেন। তিনি বলেন, ‘আবরারের স্মৃতি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছি না। যতই দিন যাচ্ছে ততই তার কথা আরও বেশি মনে পড়ছে। এখনো মনে হয়, এই জিনিস, ওই জিনিস আমাকে দিতে বলছে। স্বপ্নে পাশে এসে বসছে, কথা বলছে। বলছে দেখো মা, আমার পিঠে ঘা হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করেছি, কী করে হয়েছে। বলে, ওরা (আসামিরা) পিটিয়ে এ অবস্থা করেছে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আবরার গেইটে এসে আমাকে আম্মু বলে ডাকছে।’
রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘আজান দিলে মনে হয়, সে ওয়াশরুমে ঢুকছে অজু করতে। আমি ওর ট্রাউজার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এসব স্মৃতি ভোলার না। তারপরও বেঁচে আছি। আশায় আছি, ছেলের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হবে।’
রায় শুনতে আদালতে আসবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আসবো না। এটা শোনা অনেক কষ্টের। আর ঢাকা যাবো, সেখানে তো আমার ছেলে নেই। আমি সহ্য করতে পারবো না। ওরা (আসামিরা) তো আবরারকে আমার কাছে বেশি দিন থাকতে দিলো না। আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, হাশরের দিনে যেন আবরারের পাশে আমাকে দাঁড়াতে দেয়। অনেক সময় আমি ওর সাথে থাকতে চাই। ওরা ওকে মারছিল, মা হয়ে আমি কিছুই করতে পারিনি; ঠেকাতে পারিনি। মারা যাওয়ার আগে পানি চেয়েছিল, তাও দেয়নি। হাশরের দিনে যেন আমি ওকে পানি খাওয়াতে পারি। মারা যাওয়ার সময় ওর পাশে দাঁড়াতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘এ ঘটনা অনেক কষ্টের। ৬-৭ ঘণ্টা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে কিনা কষ্ট পেয়ে ছেলেটা মারা গেছে! যারা ওকে হত্যা করেছে তাদের শাস্তি হোক। শাস্তি থেকে শিক্ষা হোক। সাজা না হলে ওরা আমার মত আরও অনেক মায়ের বুক খালি করবে। অনেক মাকে তার সন্তানকে অকালে হারাতে হবে। ওরা যদি ছোট ভাই মনে করে দুটো চড়-থাপ্পড় দিতো, অথবা এক হাত ভেঙে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতো; তাহলে আমি ওকে চিকিৎসা করিয়ে আমার কাছে রেখে দিতাম। আমার বুকে তো থাকতো। চিরতরে ওকে চলে যেতে হতো না।’
আবরার বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ‘রায়ে সকল আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড আশা করি। কেউ যেন মামলা থেকে খালাস না পায় আমাদের সেই প্রত্যাশা। রায়টি যেন দৃষ্টান্তমূলক হয়। আর যেন আমার মত কোনো বাবা-মায়ের বুক খালি না হয়।’
তিনি বলেন, ‘গত ২ বছর ধরে ছেলের মামলায় ঢাকা-কুষ্টিয়ায় যাওয়া আসা করতে করতে আমি বড়ই ক্লান্ত। আমার শরীরও ভালো যাচ্ছে না। আবরারের মায়ের শরীরটাও খুব খারাপ। ছেলে হারানোর ব্যথা আজও ভুলতে পারেনি। প্রতিদিনই ছেলের জন্য কান্না করে। সবসময় চুপচাপ থাকে ছেলের কথা চিন্তা করে।’
বরকত উল্লাহ বলেন, ‘আবরারকে তো ওরা মেরে ফেলেছে। দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ওর ব্যবহৃত আসবাবপত্র ঠিক আগের মতই রয়েছে। ও যে ঘরে পড়তো, ঘুমোতো, টিভি দেখতো- সব কিছু আগের মত আজও আছে। শুধু আবরার নেই। তার পোশাক-আশাক সব যত্ন করে তুলে রেখেছে ওর মা। আগে কোনো অনুষ্ঠান হলে ছেলেটার সাথে ওর মা সব জায়গায় যেতো। এখন কোনো জায়গায় যায় না সে। সবসময় ঘরে বসে থাকে আর ছেলের জন্য কান্না করে। আমরা ছেলে হারানোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী দ্বারা এই ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়।’
বাংলাদেশে একটি নজির সৃষ্টিকারী রায়ের প্রত্যাশা করেন আবরার বাবা বরকত উল্লাহ।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আবু আব্দুল্লাহ ভুইঞা জানান, ‘রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য, যুক্তিতর্ক অন্যান্য আলামত আসামিদের বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ সাজার দাবি করি। ইউনিভার্সিটিতে র্যাগিং বন্ধ করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সেই আহ্বান জানাচ্ছি। এই বিষয়গুলো আমরা যুক্তিতর্কেও তুলে ধরেছি।’
তিনি বলেন, ‘এ ন্যক্কারজনক ঘটনায় সারা জাতি রায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলা পরিচালনা করে এসেছি। দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচারের দাবি করেছি। আশা করছি, ন্যায় বিচার হবে।'
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। আশা করি, রায়ে আসামিরা খালাস পাবে। কয়েকজন আসামি বলেছে, বড় ভাইয়ের নির্দেশে এই কাজ করেছে। বড় ভাই কারা? মাস্টার মাইন্ড কই? তাদের তো তদন্তে নাম আসেনি। আর বুয়েটের যারা অবহেলা করেছে, তাদেরও অভিযুক্ত করা উচিত ছিলো। কারণ এতো সিকিউরিটি থাকা স্বত্বেও রাত ৮টা থেকে তিনটা পর্যন্ত তারা কী করেছে? আবার তারা রাত আটটা থেকে তিনটা পর্যন্ত সেই ভিডিও ফুটেজ দাখিল করেননি। এখানে বহিরাগতরা প্রবেশ করেছে কিনা সম্পূর্ণ ফুটেজে তা প্রকাশ পেতো। মামলার কোনো মৃত্যু সার্টিফিকেট দাখিল করা হয়নি। আসামিদের জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি করানো হয়েছে। তারা সেগুলো পরে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আশা করি, আসামিরা মামলার রায়ে ন্যায় বিচার পাবে এবং খালাস পাবে।’
ঢাকা/ এনএইচ