১০ জানুয়ারি কেমন ছিল ঢাকার দৃশ্যপট
৭ই মার্চ যার একটি ভাষণে মন্ত্রমুগ্ধের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করেননি মানুষ, সেই মহান নেতা আসছেন। দীর্ঘ বন্দিজীবন শেষে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসছেন। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাকুল প্রতিটি জনসাধারণ। নেতাকে এক নজর দেখতে, মুখের কথা শুনতে উদগ্রীব।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার চিত্র ছিল এরকম- সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধ মানুষ। বাংলাদেশ বেতার থেকে ধারাবিবরণী দেয়া হচ্ছিল। বিমানবন্দর ও রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষমাণ জনতা। অন্যরকম উত্তেজনা সবার চোখেমুখে। বাঙালির মহান নেতা আসছেন। লাখো মানুষের ভিড় রাজপথজুড়ে। কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ। বঙ্গবন্ধু এলেন। যে দেশ এবং যে স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেই মাটিতে পা দিয়েই আবেগে কেঁদে ফেলেন তিনি। বিমানবন্দরে অস্থায়ী সরকারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা সবাই অশ্রুজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এই বরপুত্রকে।
তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করার পর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছাতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যারা দালালী ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব স্বীকৃতি দেয়ার অনুরোধ; মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে- এসবসহ বিভিন্ন বিষয়ে ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। তিনি ডাক দিলেন দেশ গড়ার সংগ্রামে। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত মন্ত্রমুগ্ধ জনতা দু’হাত তুলে সেই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন সবাইকে দেশ গড়ার ডাক দেন। সে ভাষণটি হচ্ছে নতুন দেশ পুনর্গঠনের নকশা ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা। পূর্বপ্রস্তুতিহীন এ সংক্ষিপ্ত ভাষণে অনেক বিষয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধু দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যা রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে তাৎপর্য বহন করে। পাশাপাশি বহন করে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টির। সংক্ষিপ্ত এ ভাষণেই বাঙালি জাতি ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম হন বঙ্গবন্ধু।
সেই ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাখো অনুরাগীর ভালবাসায় সিক্ত হন। বাংলাদেশের জনগণ এদিনই প্রাণভরে বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলার মানুষ তখনও জানত না তাদের নয়নমণি, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জীবিত আছেন কিনা! তাই বিজয়ের মধ্যেও মানুষের মনে ছিল শঙ্কা-বিষাদের ছাপ। এছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক উপস্থিতি ছিল অনিবার্য।
/টিপু/এনএইচ/