স্বর্গোদ্যানেই নরক দর্শন!
মারামারি হচ্ছে।
-কোথায়?
ইডেনে।
নেটওয়ার্ক জটিলতার জন্য পরিষ্কারভাবে জায়গাটার নাম শুনতে পারায় আবার প্রশ্ন করলাম- কোথায় হচ্ছে মারামারি?
এবার পরিষ্কার শুনলাম। খানিকবাদে ভিডিওতেও চলে এলো সেই দৃশ্য। মারামারি, হাতাহাতি, চুলোচুলি, চেয়ার আছড়ে একে অন্যকে পেটানোর দৃশ্য। পুরো দেশ-বিদেশ দেখলো মাস্তানি, হুমকির কুৎসিত কাণ্ড। আগে কলপাড়ায় পানির লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যেত। কিন্তু তাই বলে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এমন চুলোচুলি ও চাঁদাবাজি ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে অশান্তি!
দেড়’শ বছর পুরানো ইডেন এতদিন বিখ্যাত ছিল তার নামকরা সব ছাত্রীদের নিয়ে। এখান থেকে পাস করে অনেক কীর্তিমান সমাজ বিনির্মাণে, রাষ্ট্র গঠনে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে উজ্জ্বল, সমৃদ্ধ এবং অনুসরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। আর আজ সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলোচনায়-সমালোচনায় আসছে মাস্তানি, মারামারি, সিট দখল বাণিজ্য, মুদিদোকানে চাঁদাবাজি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায়।
এখানে পড়াশোনা কই? আছে চুলোচুলি। এখানে শৃঙ্খলা কই? আছে তোষামোদি। অসহায়ত্ব!
তবে স্বস্তির বিষয় হলো মারামারি, চুলোচুলি, মাস্তানি বা চাঁদাবাজির অভিযোগে অভিযুক্তদের সংখ্যা আপনি আঙুলের কড়ে গুনে বলে দিতে পারবেন। এই প্রতিষ্ঠানের ৩৫ হাজারের ছাত্রীদের সিংহভাগই এখান থেকে শিক্ষার আদর্শ নিয়েই ফিরতে চেয়েছেন। হাতেগোনা কয়েকজনের এখানে প্রায়সময়ে অপ্রীতিকর সব ঘটনায় শিক্ষার পরিবেশ দুষিত হচ্ছে। এমন নয় যে, এখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে খুব একটা লড়াই হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে লড়েই বিনাশের আয়োজন করছে ছাত্রলীগ।
ইডেনে ছাত্রীদের মারামারি, রংবাজি, মাস্তানির এই দৃশ্য আমাদের জানিয়ে গেল- স্বর্গ তাহলে সবসময় শান্তির জায়গা নয়। নরকের মতো এখানেও মারামারি হয়।
বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও সঙ্কট আজকের নয়, অনেকদিন পুরানো। ঢাকার বাইরে থেকে আসা কলেজ পড়ুয়া মেয়ের জন্য এই শহরে নিরাপদ আবাসিক ব্যবস্থার আশ্রয় যে কতটা দুর্লভ সেটা সবারই জানা। ছাত্রীদের জন্য কলেজ বা মহাবিদ্যালয়ের হোস্টেলই মূলত নিরাপদ আবাসিক ব্যবস্থা হওয়ার কথা। কিন্তু সেই আবাসিক হোস্টেলেই যদি পর্যাপ্ত নিরাপদ ব্যবস্থা না থাকে তাহলে এর কু-প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী।
মারামারি, চুলোচুলি, চেয়ার আছড়ে নির্বিচারে পেটানোর যে দৃশ্য ইডেনে দেখা গেছে, তাতে বাদবাকি ছাত্রীরা তো বটেই অভিভাবকরাও আতঙ্কিত। পড়াশোনা করতে এসে জীবন বাঁচাতে শিক্ষার্থীদের ছুটোছুটি করতে দেখার মধ্যে যে অভিভাবকরা নরকই দেখছেন।
একেই তো দেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে দারুণ সঙ্কটে। তারওপর যদি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ‘মাস্তানি মার্কা’ পরিবেশ ও পরিস্থিতি চলতে থাকে তাহলে এই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আরও আস্থা কমে যাবে। ইডেনের ঐতিহ্য স্বীকৃত। খোদ সেখানেই যদি মারামারি, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, চুলোচুলির কুৎসিত দৃশ্য, তাও আবার নিজ দলের মধ্যেই; এ যে সামগ্রিক ব্যবস্থা আস্থাহীন হয়ে উঠার ঘোষণা দিচ্ছে!
সমস্যাটা ইডেনের। সমাধানও তাদেরই করতে হবে। স্বর্গোদ্যানের প্রশাসনের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদেরই সাহসী হতে হবে। কোন হলে কে থাকবে। সিট বরাদ্দ হবে কার নামে- এসব প্রশাসনিক কাজ ও নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েই তো তারা চেয়ারে বসেছেন। সেই দায়িত্ব তাদেরই পালন করতে হবে। সেই দায়িত্বের ‘শেয়ার’ তো তারা কাউকে দিতে পারেন না। পালন করতে না পারলে বলে দিন- আমরা অসহায়, সরে যাচ্ছি। অন্য পাহারাদার পাঠান।
তবুও নিরাপদ থাকুক স্বর্গোদ্যান!
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিবিডি ডটকম।
ঢাকা/এনএইচ